বই- কারাগারের রোচনামচা – oshomapto attojiboni pdf Download
লেখক- শেখ মুজিবুর রহমান
করোনা কালে আমরা যারা ঘর বন্ধী থেকে হাফিয়ে উঠেছিলাম তারা কি জেলখানার ভিতরে একা বন্ধী থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন? গৃহ বন্ধী থাকার সময়েও আমরা একা বন্ধী ছিলাম না, ঘরের সবার সাথে বন্ধী ছিলাম। সেইবারের ঈদে আমরা বাহিরে বের হতে না পারলেও ঘরে ছিলাম যার যার প্রিয় জন, আপনজন অর্থাৎ পরিবার নিয়ে।
আমরা কয়জন জানি বা বুঝতে পারি একা জেলখানার একটা রুমে বন্ধী থাকার যন্ত্রণা? আমরা কয়জন ঠিক করে জানি যে জেলখানায় একা ঈদ করার যন্ত্রণা? নিজের অসুস্থ বাবা-মা কে দেখতে না পারার যন্ত্রণা? নিজের স্ত্রী সন্তানদের কাছে না পাবার যন্ত্রণা? এই যন্ত্রণা চোখে দেখা যায় না আর যাবেও না। কিন্তু কিছুটা হলেও অনুভব করতে চান? আন্দাজ করতে চান কেমন হতে পারে সেই সব অবস্থা।তাহলে দেরি না করে পড়ে ফেলতে পারেন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, রাষ্ট্রপতির নিজস্ব আত্মজীবন মূলক বই “কারাগারের রোজনামচা”।
বইয়ের প্রতিটা পাতা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন কি যন্ত্রণার জীবন তিনি কাটিয়েছেন জেলখানার ওই ক্ষুদ্র কুঠুরিতে। আসুন তার উপরে একটা সংক্ষিপ্ত মন্তব্য শুনে নেয়া যাক।
“ থালা বাটি কম্বলজেলখানার সম্বল”।
দুই লাইনের ছোট এই কথা থেকেই জেলখানার দিন গুলোর করুন অবস্থা ফুটে উঠে। এমনটাই দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে। মূলত এইটা উনার জেলখানায় বসে লেখা নিয়মিত ডায়েরি ছিলো। উনার এই লেখার প্রেরণায় ছিলেন উনার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব যাকে উনি ডাকতেন রেনু বলে। পরবর্তীতে এই লেখা যখন গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে তখন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা তার নাম দেন কারাগারের রোজনামচা।
বইয়ের প্রথমেই শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় প্রচলিত কিছু মজাদার শব্দের সাথে আমাদের পরিচিত করান যা সাধারণ লোক সমাজের কাছে একদমই অপরিচিত কিংবা নতুন। পুরো বইটিতে এই শব্দ গুলো যেমন কাজে আসবে ঠিক তেমনি এই বইটি পড়ার পরে জেলখানার মধ্যে ব্যবহৃত এই শব্দগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে পারবো। যে,পম কেসটাকোল, চৌকি দফা, রাইটার দফা, শয়তানের কল, দরজি খাতা এমন আরো কত কি!
শুরুটা মজা দিয়ে শুরু করলেও পুরো বইটাতে ছিলো জেলখানার ভিতরে কাটানো এক একটা যন্ত্রণার দিনের কথা। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন, সেই সময় থেকে তিনি ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত জেলখানার ভিতরে একা একটি রুমে দিন রাত কাটিয়েছেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি উনাকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
দীর্ঘ এই কারাবাসের সময়গুলোতে উনাকে মানসিক আর শারিরীক দুই দিক থেকেই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল। অধিকাংশ সময়ে তাঁকে ‘solitary confinement’ অর্থাৎ একাকী বন্দী জীবনযাপন করতে হয়েছে। কারাগারের ভিতরে চাচ্ছিলেন উনি অসুস্থ কিংবা দুর্বল হয়ে পড়ুক। কিন্তু উনার লড়াই ছিলো যাই হয়ে যাক নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে হবে। সেই লড়াইয়ে উনি সব সময় সফল ছিলেন না।
আর মনের লড়াইয়ের তো শেষ ছিলোনা। জেলখানার ওই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে উনার শেষ ভরসা ছিলো বই আর খবরের কাগজ, সেখানেও সুখ ছিলোনা উনার। খবরের কাগজ দিতে দেরি হতো, এই খবরের কাগজ পাবার জন্যও তাকে সংগ্রাম করতে হতো। উনাকে যেই খবরের কাগজ দেয়া হতো সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খবর ডেকে দেয়া হতো যাতে করে এই দেশের রাজনীতিতে কি হচ্ছে উনি জানতে না পারেন।
একই জেলখানায় উনার দলের অনেক নেতাকর্মী থাকার পরেও তাদের সাথে উনার দেখা হতোনা, এমনকি উনার নিজের আপন ভাগীনার সাথেও না। দিনের পর দিন উনি পরিবার থেকে দূরে থাকতেন। ১৪-১৫ দিন পর নিজের পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন সেখানেও থাকতো নিরাপত্তা, হতে পারবেনা কোন রাজনৈতিক আলাপ- আলোচনা।
সেই এক ঘণ্টা উনাকে যতটা না আনন্দ দিতো তার থেকে বেশি দিতো মনের যন্ত্রণা। ছোট ছেলে মেয়েরা উনাকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য বায়না করতেন কিন্তু উনি থাকতেন নিরুপায়। দুঃখকে ভিতরে রেখে উনি ছোট ছেলেকে নানান ভাবে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতেন। একজন জন্মদাতার জীবনে এর থেকে বড় কষ্ট আরে কিসে? নিজের ছেলেকে বুঝাতেন এই কারাগার তার বাবার বাড়ি আর তাদের ফিরে যেতে হবে তাদের মায়ের বাড়ি। অবুঝ শিশুর বাবা কোথায় আবদার মিটাতে তাকে শিখানো হয়েছিল তার মা হচ্ছেন তার মা আর তার মা ই হচ্ছেন তার আব্বা। আহা! কি বেদনার, কি যন্ত্রণার।
জেলখানায় থাকাকালীন শেখ মুজিব তার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছটফট করে যান দিনের পর দিন কিন্তু তার দেখা করার কোন উপায় ছিলোনা। বাহিরে অসুস্থ মায়ের খবর শুনে জেলখানায় বন্ধী থাকা একটা সন্তানের জন্য মোটেও সুখকর কিছু নয়!
বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা দেখার দুর্লভ সুযোগ আছে বইটিতে। এছাড়া বইটির শেষে ১৯৫৫-১৯৭৫ সালব্যাপী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, টীকা অংশে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুর্লভ কিছু ছবি এবং ৬ দফার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে; যা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চমৎকার ধারণা পাওয়া যায়।
তাছাড়া বাবা জেলে থাকা অবস্থায় সন্তানদের কাছে ঈদের যে কোন মানেই থাকে না কিংবা জেলখানার কয়েদীদের কাছে ঈদ যে আলাদা কোন দিন হয়ে আসেনা এমন কষ্টের দৃশও ফুটে উঠেছে এই বইতে।
আইয়ুব- মোনায়েম সরকার দিনের পর দিন নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য একজন মানুষকে নির্বিচারে অসংখ্য দিন নিজের কাছের মানুষদের থেকে দূরে রেখে আটকে রেখেছিল।
বইটিতে ১৯৬৮ সালের ঘটনা পর্যন্ত তুলে হয়ে হয়েছে।
১৩৭৩ বঙ্গাব্দের ২৪শে বৈশাখ থেকে তিনি জেলে বন্দি। পরবর্তী বৈশাখ টাও কাটাতে হচ্ছে জেল খানার চার দেয়ালের ভিতরে। ১৯৬৬ সালে “ছয় দফা” ঘোষণার পরে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলা রাখা হয়।
বইটিতে প্রথম ২রা জুন,১৯৬৬ সাল, বৃহস্পতিবারের ঘটনা দিয়ে লেখা শুরু করেন।
তারপর কেটে যায় পাল্টে যায় কত বার,মাস, কয়েদিদের ঠিকানা,মুরগি পাখির আস্তানা। শুধু পাল্টায়নি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারহীন কারাবাসের দিনের রুপ। তিনি পাকিস্তানের ভাগ চায়নি; সে কথা তিনি উচ্চারণও করেন নি। শুধু চেয়েছেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালির অধিকার।
কিন্তু আইয়ুব খানের শাসনামলে এ কথাও বলা বারণ যে, “তোমার নিজের জমি অন্যরা ভোগ করবে তা তুম বলতে পারবেনা, প্রতিবাদ করা হবে পাপের সমতূল্য।”
জেলের ভিতরে আপন বলতে ছিল নিজের হাতে গড়া বাগান আরো ছিল মুরগি,পাখি। যার বর্ণনা কত সুন্দরভাবে লেখক তুলে ধরেছেন।
সেই সময়ে উনার লেখা এই ডায়েরি বর্তমান সময়ের জন্য খুব উপকারী। সেই সময়ের প্রকৃত রাজনৈতিক অবস্থা, দুই পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান সব কিছুই ফুটে উঠেছে উনার লেখায়। এমনকি উঠে এসেছে একজন প্রকৃত রাজনৈতিক নেতার আত্মত্যাগ আর মনোবল।
credit- সিফাত হাছান সুমাইয়া
কারাগারের রোজনামচা Pdf Download link-