sondhamaloti Sadiqul Neugi Ponney Books pdf

Sadiqul Neugi Ponney Books সন্ধ্যামালতি সাদিকুল নিয়োগী পন্নী
বই : সন্ধ্যামালতি
লেখক : সাদিকুল নিয়োগী পন্নী
প্রকাশনায় : অনিন্দ্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
পৃষ্টা সংখ্যা : ৭৯
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০ টাকা
ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে সূর্য যখন তেজ ছেড়ে নরম আলো বিলায়, রাতের আঁধার যখন আসবে বলে উঁকিঝুঁকি দেয়, তখনই নিজের সবটুকু রূপ ছড়িয়ে ফোটে এক ফুল। নাম তার সন্ধ্যামালতি। কেউ কেউ ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে সন্ধ্যামণি, কেউ বা ডাকে কৃষ্ণকলি।
সন্ধ্যালগনে ফুটে বলে ফুলের নাম সন্ধ্যামালতি হলেও লেখক সাদিকুল নিয়োগী পন্নী রচিত ‘সন্ধ্যামালতি’ গল্পগ্রন্থটি ফোটেছে দিনের আলোয়, কিছু জীবনের গল্প নিয়ে। আসলে গল্পের প্রতি মানুষের আসক্তি শিশুকাল থেকেই। শিশুদের তুষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের মায়েদের অথবা দাদি-ঠাকুরমাদের গল্পের কারিগরির শুরু কতকাল আগে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের সংগৃহীত ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলি কত যুগ ধরে এদেশের শিশুরা শুনে আসছে সে-তথ্য সম্ভবত দক্ষিণারঞ্জনও দিতে পারেননি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিশুতোষ গল্পগুলির মধ্যে টুনটুনির গল্প, শেয়াল-কুমিরের গল্প কিংবা রাখালের পিঠাগাছের গল্প এখনো প্রচলিত।
তবে সাদিকুল নিয়োগী পন্নী গল্প লেখেন বাস্তব জীবনের গল্প। আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া এই গল্পগুলো একেবারেই যেন চিরচেনা, চিরায়ত জীবনের গল্প।
সন্ধ্যামালতি গল্পের নামানুসারে গল্পগ্রন্থটির নাম ‘সন্ধ্যামালতি’ হলেও মোট ১১টি গল্প স্থান পেয়েছে এই বইটিতে। বইয়ের নামকরণের

এই গল্পটি একজন পোড় খাওয়া মানুষের বিধ্বস্ত হৃদয়ের হাহাকারের বহিঃপ্রকাশ। যে গল্পের শুরুটা রোমাঞ্চ দিয়ে হলেও এর যবনিকাপাত ঘটে ফাঁসির মঞ্চে। লাল সালুতে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা সামনে নিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র আজাদ তার স্বপ্নের মানুষ মালতিকে ভালোবেসে কিভাবে আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তা প্রকাশ করে জেলার রফিক সাহেবের কাছে।

‘বাবার ডায়েরি’ গল্পটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক একটি অসমাপ্ত স্মৃতির আখ্যান। লেখক তার বাবার লেখা পুরনো ডায়েরি থেকে গল্পটি সংযোজন করেছেন। গল্পের আদলে লেখা এ গল্পটিতে উঠে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একখন্ড বাংলাদেশের কথা। দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া কিছু সাহসী মানুষের বাস্তব জীবন যুদ্ধের কথা।
‘রূপান্তর’ গল্পটিতে লেখক দেখিয়েছেন আচমকা পাল্টে যাওয়া একটি সমাজ, কিছু মানুষের জীবনবোধের কথা। অর্ণব নামের তরুণটি হৃদিতাকে ভালোবেসে নিজেকে কিভাবে রূপান্তরিত অন্ধগলির বেড়াজালে একটা সময় আবিষ্কার করেছে, লেখকের সুনিপুণ কলমের ছোঁয়ায় তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
‘শেষ আলিঙ্গন’ গল্পটি পড়ে মনের অজান্তেই দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরেছে কফোটা নোনাজল। মৃত্যুর ঠিক কাছাকাছি সময়ে আয়ান যখন চরম ব্যাকুলতায় পুষ্পকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ করছিল জীবনের অব্যক্ত কথাগুলো, সত্যিই নিজেকে সংযত রাখতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমার।
‘স্বপ্ন এক্সপ্রেস’ গল্পে একটা নতুন জীবনের আগমনের সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে আরেকটা তরতাজা জীবনের। আচমকা এক ট্রেন দুর্ঘটনায় নিভে যায় অনিলের জীবনপ্রদীপ। ওপাশে হাসপাতালের সুনশান নিরবতা ভেঙ্গে প্রচণ্ড চিৎকারে রিতার কুলজুড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় সদ্য ভুমিষ্ট এক মানব শিশু। অথচ অনিল তখন পরপারের টিকিট হাতে ব্যস্ত উপরিওয়ালার ডাকে সাড়া দিতে। এই যে মানব জীবনের নিষ্টুর প্রহর, লেখক কতইনা দরদ দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
এমনিভাবে ‘প্রেমলীলা’ গল্পে লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে ইতু নামের এক রহস্যময়ী নারীর অভিনব প্রতারণার কথা। ‘শাড়ি’ গল্পটি আদতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি এক অন্যরকম শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। ‘গল্পের পেছনের গল্পে’ লেখকের কলমের আঁচড়ে উঠে এসেছে আমাদের সমাজের কিছু মানুষের সাফল্যগাঁথা জীবনের কথা। ‘প্রবাসীর বর’ গল্পটিতে উঠে এসেছে আবির আর অধরার ভালোবাসার অনিমেষ পরিণতির কথা।
‘পন্ডিত’ গল্পটি যেন এই সমাজে আমারই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো এক বাস্তব গল্পের রূপদানের সফল চেষ্টা। এই সমাজে আচমকা বদলে যাওয়া রাহুলদের যেমন অভাব নেই, অভাব নেই সুখেন মাস্টারের মতো নিস্বার্থে জীবন বিলিয়ে দেয়া মানুষদেরও।
‘সন্ধ্যামালতি’র সবশেষ গল্পটির নাম ‘আনন্দাশ্রু’। এ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন সৎ মায়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া শ্রুতি নামে এক তরুণীর প্রাণপণ জীবনযুদ্ধের কথা। স্বর্ণলতার মতো মামার বাড়ি নামক শেষ আশ্রয় থেকে বিতাড়িত হয়ে অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর শেষ লগ্নে প্রিয় মানুষ অরিণের উপস্থিতিতে মুহুর্তেই বদলে যায় শ্রুতির আবেগ-অনুভূতি। শ্রুতির ভেতরে দীর্ঘদিনের লুকায়িত বরফখন্ড তাই প্রচন্ড উষ্ণতায় যেন বায়ুমন্ডলের মতো কান্না হয়ে গলে পড়ে।
দীর্ঘদিন পর চমৎকার একটি গল্পগ্রন্থ পড়ে শেষ করলাম আজ। বইটি নিয়ে শুরু থেকেই আমার উচ্ছ্বাস ছিল সীমাহীন। রকমারিতে অর্ডার করেও ঠিক সময় হাতে না পাবার একটা অজানা মানসিক যন্ত্রণায় বিভোর ছিলাম এ কয়টা দিন। বইয়ের নাম এবং প্রচ্ছদ দুটোই দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল আমাকে। অবশেষে আজ হাতে পেয়ে এক বসাতেই পড়ে শেষ করলাম। ওবায়েদ হকের ‘কাঙালসংঘ’ অর্ধেক পড়ে রেখে দিয়ে সন্ধ্যামালতির প্রেমে ডুব দেয়া ছিল বইটি নিয়ে আমার বাড়তি আগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ।
বইটিতে লেখক কলমের খোঁচায় দেখিয়েছেন অসাধারণ কথনভঙ্গির কারুকাজ। জীবন যখন গল্পে চলে যায় এবং ওই জীবন-চরিত্রে লেখকের বিনিয়োগও বাড়ে, সন্ধ্যামালতি হলো এর উৎকৃষ্ট উপমা।
গল্প মানুষের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলে, উপন্যাস আমাদের যাপিত জীবনকে কীভাবে অর্থপূর্ণ করে? গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ‘আমরা যে জীবন যাপন করছি তা কিন্তু আমাদের সত্যিকারের জীবন নয়। যে জীবনের কথা ভাবতে আমরা ভালোবাসি, যে জীবনের গল্প আমরা বারবার করি – সেটাই আমাদের প্রকৃত জীবন। তেমনিভাবে ‘সন্ধ্যামালতি’ গল্পগ্রন্থে লেখক প্রকৃত জীবনের গল্প পাঠকের চিলেকোঠায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
গল্প নিয়ে বিদগ্ধ বাক্যমালা সাজানোর যোগ্যতা আমার মোটেও নেই। জ্ঞানবুদ্ধি বা অধ্যয়নের বিজ্ঞতায় গল্পের ব্যবচ্ছেদ করার দুঃসাহসও রাখি না। ধৃষ্টতাবশে দু-চারটি গল্প কখনো কখনো লিখেছি। সেগুলো আদৌ গল্পের কঠিন শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা যে রাখে না, সেটাও জানি। আমাদের সবার জীবনেই গল্প আছে, গল্প আছে চেনাজানা দূরের-কাছের সব মানুষেরই। সেসব গল্প কেউ বলে, কেউ বলে না। তবু নিজের গল্প অন্যকে বলা, বা অন্যের গল্পগুলো শ্রুতি ও বোধ দিয়ে অনুভব করা তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমি পেরেছি সন্ধ্যামালতির প্রতিটি গল্পকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে।
ল্যাটিন আমেরিকার গল্প সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের একটি লাইন দিয়ে আমি পাঠপ্রতিক্রিয়ার যবনিকাপাত টানতে চাই। তিনি বলেছেন ‘ইতিহাস আর দর্শনের দুই প্রবল ঘোড়া গল্পের কাছে বাগ মেনেছে।’ তিনি আগুনপাখি উপন্যাসের শেষে এসে এক নারীর জবানিতে বলছেন, ‘মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছেড়ে দেয়, আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলাম। শ্যাষে আমার একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে গল্পের অভ্যন্তরে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি।’ এই যে জীবন দর্শন, দর্শনের সেই তল্পিতল্পা থেকে ইতিহাস, মানবমনের অলিগলি, প্রেম-ভালোবাসা, নিঃসঙ্গতা অথবা ব্যাপক আনন্দমুখর এক জীবনের গল্প – সবই উপন্যাস খুঁজে বেড়ায় এবং সর্বোপরি সময়ের ভেতর অসময়, অসংগতি – সবকিছুকে ধারণ করে। লেখক সাদিকুল নিয়োগী পন্নী তার প্রতিটি গল্পে জীবন দর্শন আর বাস্তবতাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
এই লেখকের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় আমার। সন্ধ্যামালতি পড়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, প্রকৃত অর্থেই গল্পের মানুষ তিনি। তার গল্প বলার ধরণ অসাধারণ। বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে স্বীয় প্রতিভা দিয়ে একটা জায়গা করে নিবেন তিনি। এ গল্পগুলো তাকে, তার লেখাকে বাঁচিয়ে রাখবে আমৃত্যু।
প্রিয় পাঠক, আপনি যদি জীবনের গল্পে নিজেকে সিক্ত করতে চান, জীবনকে গল্পের আদলে খুবই কাছ থেকে অনুধাবন করতে চান, নিঃসংকোচে হাতে তুলে নিন লেখক সাদিকুল নিয়োগী পন্নী রচিত গল্পগ্রন্থ ‘সন্ধ্যামালতি’। আমার বিশ্বাস, প্রত্যাশা থেকেও প্রাপ্তির পাল্লাটা ভারী থাকবে। সো হ্যাপি রিডিং।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *