বইয়ের নাম: আদর্শ হিন্দু হোটেল pdf
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশন: নাঈম বুকস ইন্টারন্যাশনাল
মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা
“ক্যাহেতে হ্যায়…… আগার কিসি চিজ কো দিল সে চাহো তো পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানি কি কোশিস ম্যায় লাগ যাতি হ্যায়…।”
ডায়লগটা কমবেশি পরিচিত। মন থেকে কিছু চাইলে, আর তা পাওয়ার জন্য একাত্বতা থাকলে পথ যতোই বন্ধুর হোক না কেন সব কিছুই ঠুনকো মনে হয়।
নাম হাজারী দেবশর্মা। স্ত্রী, পুত্র আর কন্যা থাকে এঁড়োশোলা গ্রামে। কাজের সন্ধানে আসেন রাণাঘাটে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে।
রাণাঘাটের বেচু চক্কত্তির বিখ্যাত হোটেলের নাম ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। পাঁচ বছর আগে এখানেই রাধুনি বামুণের কাজ নেন হাজারী ঠাকুর। সাত টাকা মাসিক ও দুইবেলা আহার পান হোটেল থেকে। হোটেলের নাম বৃদ্ধির পিছে সবথেকে বড়ো অবদান হাজারী ঠাকুরেরই। রান্নায় তার থেকে পারদর্শী আর কেউ নেই। একবার যে তার রান্না খেয়েছে, সে বারবার ফিরে এসেছে রাণাঘাটের রেল-বাজারের এই হোটেলে। হাজারী ঠাকুরের রান্নার সুখ্যাতি সব কাস্টমারের মুখে মুখে। সকলেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, শুধু একজন বাদে।
পদ্ম ঝি দু’চোখে দেখতে পারেনা হাজারী ঠাকুরকে। হাজারী তাকে সম্বোধন করে ‘পদ্মদিদি’ বলে। হাজারীর পাওয়া সব প্রশংসা ম্লান হয়ে যায় পদ্মদিদির কাছে এসে। উঠতে বসতে তাকে অপদস্ত হতে হয়। এমনকি হাজারী ঠাকুরের নামে মিথ্যাচার করতেও পিছপা হয়না। তবে এ নিয়ে কোন অভিযোগ নেই হাজারীর। সব অপমান সে নীরবে সহ্য করে। হোটেলে পদ্মঝি’র কথাই শেষ কথা, এমনকি মালিক বেচু চক্কত্তিও পদ্মঝি’র কথার বাইরে কথা বলেনা। পদ্মঝি আর চক্কত্তির মাঝে সম্পর্ক আছে এ নিয়েও নানা মুখে নানা কথা আছে।
দুপুরের রান্না সেরে লোক খাইয়ে হাজারী ঠাকুর আসেন রাধাবল্লভ-তলায় নাটমন্দিরে। এখানে বসে সে নিজের মনে ভাবেন। বড়ো শখ তার একটা হোটেল খুলবেন। এত বছর থেকে হোটেল ব্যবসা সে খুব ভালো করে শিখে ফেলেছেন। রাণাঘাটেই নিজের হোটেল খুলে বসতে পারলেই তার শখ পূরণ হবে। কিন্তু কথায় আছে না, ‘সাধ আছে, সাধ্য নেই’। হাজারী ঠাকুরের সেই দশা। সাত টাকা মাইনের কাজে সংসার চালিয়ে, হোটেলের মিথ্যা অপবাদে মাঝে মাঝে মাইনের টাকা থেকে জরিমানা দিয়ে হোটেল খোলার সেই সাধ পূরণ হয়না।
রান্নাঘরের উনুনে জ্বলজ্বল করে ওঠা আগুনের মতোই চোখে তার স্বপ্ন জ্বলজ্বল করে। রাণাঘাটে তার একজন স্নেহের মানুষ আছে। সে হলো বিধবা কুসুম। হাজারীর গাঁয়ের মেয়ে। সন্তান আর শাশুড়ি কে নিয়ে রাণাঘাটে অতিকষ্টে জীবন পার করছে দই বেচে। কুসুমকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন হাজারী ঠাকুর। হোটেলের নিজের ভাগের খাবার থেকে মাঝে মাঝে কুসুমকেও দেন। এ নিয়েও পদ্মঝি’র তোপের মুখে পড়তে হয়েছে অনেক। বাপ-মেয়ের পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে কুট কথা বলে পদ্মঝি। হাজারীর মনের শখ কুসুমকে বলেছিলেন। কুসুম তার নিজের শেষ সম্বল দিয়ে দিতে চায় যেন দেবতাতুল্য এই লোকটি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন।
মাঝে হাজারী ঠাকুরের জীবনে অনেক চরাই-উতরাই আসে। আসে অনেক শুভাকাঙ্খী যারা এই রাধুনি বামুণের অন্তরে লালিত এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অবদান রাখতে চায়। হাজারী ঠাকুর কি পেরেছিলেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে? না-কি আজীবন রাণাঘাটের সেই বদ্ধ রসুইঘরের উনুনের সামনে ঘেমে নেয়ে অপবাদ সহ্য করেই বাকী জীবন পার করেছেন? কুসুম, অতশী, গায়ের সেই বউ এদের করতে চাওয়া উপকার কি নিয়েছিলেন নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য? পেরেছিলেন কি রাণাঘাটের ধারে নিজের হোটেলের মালিক হতে?
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পড়া দ্বিতীয় বই এটি (পথের প্যাঁচালী, চাঁদের পাহাড় গল্প পড়েছে আমি শুনে গেছি। তাই এই দুইটা শোনার লিস্টে আছে)। ইংরেজ শাসনাধীন সময়ে লেখা এই উপন্যাসটি পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত। বইটা যতক্ষণ পড়েছি একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করেছে। পড়া শেষে যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পেরেছি। প্রথমে কিছুটা ধীর গতির মনে হলেও ক্যারেক্টার বিল্ডাপের জন্য এই ধীর গতির দরকার ছিল।
বইটা নিয়ে নিজে কিছু লেখার আগে অন্যদের লেখা মন্তব্য পড়ে নিয়েছিলাম। অনেকেই বলেছেন, উপন্যাসের নায়ক তথা মূল চরিত্র অতোটা শক্ত নয়, ভীরু ধরনের। তাকে দুর্বল রূপে দেখানো হয়েছে। আমার মতে গল্পে মূল চরিত্র মানেই তাকে বীরদর্প হতে হবে, বা সাউথ সিনেমার মতো এক ঘুষিতে ৫ তলা ভবন কাঁপিয়ে ফেলবে এমন নয়। তার চরিত্রের ভালো-খারাপ দিক থাকবে, কিছুক্ষেত্রে সেও উদার না হয়ে স্বার্থপর হবে। চরিত্রের সব দিক মিলিয়েই সে হয়ে ঊঠবে অনন্য। হাজারী ঠাকুর চরিত্রে দুর্বলতা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য তার একগ্রতা তাকে অনন্য করে তুলেছে। শত অন্যায়-অবিচার সহ্য করেও যিনি অপকারীর ভালোই চেয়ে গেছেন সে ‘হিরো’ নয়তো আর কী হতে পারে? প্রতি পাতা পড়ছিলাম আর মনে আশংকা তৈরি হচ্ছিল এই বুঝি এলো ঝড়, আর সব ওলট পালট করে দিল (দিন রাত থ্রিলার, মার মার কাঁট কাঁট জনরা পড়ার আউটকাম আরকি!)।
উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো থেকে একটা গানের লাইনই বারবার মনে পড়েছে, ‘পুরুষ বড় হয় জগতে নারীর কারণে, ধ্বংস হয়ে যায় আবার ঐ নারীর কারণে।’ তবে এখানে নারী চরিত্রগুলো প্রশংসার দাবীদার। এমনকি পদ্মঝিকেও মাঝে মাঝে বেশ রহস্যময়ী মনে হয়েছে।
লেখকের লেখায় কোন মেদ নেই। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আলগা কিছু নেই যা হজম হবেনা। তারানাথ তান্ত্রিক দিয়ে শুরু করেছিলাম। আদর্শ হিন্দু হোটেল পড়ার ইচ্ছা অনেক দিনের ছিল। এটা শেষ করার আগেই ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’ আনিয়ে নিয়েছি। সাধুভাষা পড়তে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, পড়তে সময় লাগে। তবুও লেখকের লেখার টানে এই বেগটুক উপভোগ্য।
#পছন্দের_উক্তি:
১) মুখ ফুটিয়া যাহা বলা যায় না, মনে মনে তাহা বলিয়াও সুখ।
২) ইহকালই দেখলি নে, ভোগ করলি নে, তোদের পরকালে কি হবে বাপু?
Link: আদর্শ হিন্দু হোটেল Pdf