“তোমাকে বুঝি না প্রিয়, বোঝো না তুমি আমায়, দূরত্ব বাড়ে, যোগাযোগ নিভে যায়…” এই তথ্য, প্রযুক্তির যুগে কারো সাথে যোগাযোগ করা এখন কোনো ব্যাপারই না। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হটসএ্যাপ, ইমু ইত্যাদি অসংখ্য যোগাযোগের মাধ্যম আছে। কিন্তু তারপরেও গানের মত কি মনের দূরত্ব ঘুচেছে? দুটো মানুষের মধ্যে মনে মনে যোগাযোগটা যদি নিবিড় না হয় তাহলে সেখানে হাজার কথা, আর্তনাদ, চিৎকার বৃথা। সেগুলো মানুষ দুটোর মধ্যে তৈরি অদৃশ্য দেয়ালে এসে করাঘাত করে ঠিকই কিন্তু দেয়াল ভেদ করে প্রবেশ করতে পারে না। আবার যদি উল্টোটা হয় তাহলে সেখানে একজন আরেকজনের নিরবতার ভাষাও বুঝে নেয়। আমরা সারাজীবন এমন একজন মানুষকেই খুঁজি যার সাথে আমাদের যোগাযোগের জন্য বাহ্যিক কোনো মাধ্যম লাগবে না। সে যেন আমাদের মনের ভাষাটা পড়তে পারে। কিন্তু চাইলেই কি দেখা মেলে এমন একজনের? নির্মম বাস্তবতায় দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর মানুষও যোগাযোগহীন সারাজীবন একসাথে কাটায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “যোগাযোগ” উপন্যাসে মানুষে মানুষে এমন বিচিত্র যোগাযোগের স্বরূপই ভিন্নরূপে অঙ্কণ করেছেন।
যোগাযোগ উপন্যাসের সারসংক্ষেপ
কাহিনিসংক্ষেপ: উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে মূলত দুটো বংশের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। চাটুজ্যে আর ঘোষাল এই দুই বংশের মধ্যে বহুকাল ধরে দেবতার পূজো ও আরো নানা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শত্রুতা রয়েছে।দুটো বংশই চায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে। একসময় ঘোষালদের অবস্থা খারাপ থাকলেও মধুসূদন ঘোষালের হাত ধরে ঘোষালদের অবস্থা এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।বাপ মরার পর মধুসূদন পড়াশোনা আর বেশিদূর করল না। ব্যবসায় জগতে পদার্পণ করল সে। ছাত্রমহলে সেকেন্ড হ্যান্ড বই বিক্রি করে যে ব্যবসায়ের শুরু সেটা ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হল।ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত মধুসূদনের বিয়ে করারও ফুরসত নেই। বিয়ের বাজারে তার বিপুল চাহিদা থাকলেও তার চাই চাটুজ্যে ঘরের মেয়ে। এদিকে নূরনগরে অবস্থানরত চাটুজ্যেদের অবস্থা বিশেষ ভালো না। ঐশ্বর্য কমে গিয়ে নানারকম দেনায় ডুবে আছে। পরিবারে দুই ভাই, পাঁচ বোন। কন্যাধিক্য অপরাধের জরিমানা এখনও শেষ হয়নি। চারবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি আছে সবার ছোট কুমুদিনী। বড়দাদা বিপ্রদাস যেন কুমুঅন্তঃপ্রাণ। কুমুও দাদার আদর্শ সর্বদা হৃদয়ে লালন করে। তবে কুমুর রয়েছে দেবতার প্রতি পরম ভক্তি। কুমু কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ভাগ্যে বিশ্বাসী। এদিক থেকে তার দাদা সম্পূর্ণ আলাদা। কুমুকে সে পড়াশোনা, এসরাজ বাজানো, গান শেখানো, দাবা খেলা ছাড়াও আরো অনেক কিছু শিখিয়েছে। তার কাছে কুমু একজন একনিষ্ঠ শিষ্যা কিন্তু কুমুর ঐ দেবতা ভক্তি আর ভাগ্যবিশ্বাসের জায়গায় বিপ্রদাস হাত দিতে পারেনি। কুমু নিজেকে অপয়া ভাবে এবং ভাইদের গলগ্রহ মনে করে তাই যখন ঘোষালদের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে সে সেটা নিজের অন্তরাত্মার ডাক আর ঈশ্বরের ইচ্ছে মেনে বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। বিয়ের সময় নানা জটিলতা তৈরি হয় এবং অবশেষে বিয়েটা হয়। বিয়ের পর কুমুর মধ্যে তৈরি হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে এতকাল স্বামীকে পরম পূজনীয় হিসেবে মেনে নেওয়া সংস্কারে আবদ্ধ ছিল কিন্তু মধুসূদনের দয়া,মায়া,ভালোবাসাহীন, সর্বদা নিজের প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা মূর্তির সাথে কুমু নিজের অন্তরে লালন করা স্বামী মূর্তির মিল খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্যদিকে মধুসূদন প্রতিশোধের খাতিরে কুমুকে বিয়ে করলেও কুমুকে ভালোবেসে ফেলে কিন্তু সে ভালোবাসায় সে অন্যকারো স্থান সহ্য করতে পারে না। কুমুর দাদা বিপ্রদাসেরও সেখানে কোনো জায়গা নেই। অহংকারী, নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে এতকাল মনে করা মধুসূদনও কুমুর সরলতার কাছে হার মানে কিন্তু সেটা একান্ত তার মনে মনে। কুমু একসময় আবিষ্কার করে মধুসূদনের সাথে তার জাতের তফাত, ধাতের তফাত। তার কাছে স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ কঠিন হয়ে ওঠে। ঘটনাচক্রে কুমু তার দাদার কাছে চলে আসে। শেষ পর্যন্ত কি দুটো মানুষের মনের যোগাযোগ হয়েছিল? জানতে হলে বইটি পড়তে হবে।
চরিত্র বিশ্লেষণ: এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায় তিনটি। কুমুদিনী, মধুসূদন ও বিপ্রদাস।
এছাড়াও আরো অনেক পার্শ্ব চরিত্র ছিল।
কুমুদিনী: সুন্দরী, লম্বা, ছিপছিপে, শাঁখের মত চিকন গৌর গায়ের রং আর তার নিটোল দু’খানি হাত। লেখক কুমুদিনীর মধ্যে বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। কুমুদিনী পরম দেবতা ভক্ত, কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আবার একইসঙ্গে বাস্তবতার সাথে বিশ্বাসের অন্তর্দ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত তবে তার মধ্যে দয়া ও আত্মমর্যাদা এবং শেষে আত্মোপলদ্ধিও রয়েছে।
মধুসূদন: নেতিবাচক এক চরিত্র। যার মধ্যে ব্যবসায়ের হিসাব কষতে কষতে জীবনের সহজ, স্বাভাবিক, সুন্দর দিকগুলো হারিয়ে গেছে।
বিপ্রদাস: সমগ্র উপন্যাসে যে খুবই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল। ব্যক্তিজীবনে নিঃসঙ্গ বিপ্রদাস, দেনার দায়ে ডুবে থাকলেও যার আত্মমর্যাদা প্রবল। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিপ্রদাসের পরাভব কুমুর মধ্যে কুসংস্কার আর স্বামী মাত্রই পরম ভক্তির স্থল এই ধারণার বদল ঘটাতে না পারায়।
মোতির মা: কুমুর মেজ জা। কুমুর প্রতি অত্যন্ত স্নেহ প্রবণ তবে তার মধ্যে হাজার বছর ধরে বাঙালি মেয়েদের মনে যে চিন্তা লালিত তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।
নবীন: কুমুর মেজ দেবর। মোতির মা নিস্তারিনীর স্বামী। কুমুর প্রতি অন্ধ ভক্তি যেন রামায়ণের লক্ষ্মণ। তবে দাদার প্রতিও কর্তব্যরত, বিশ্বস্ত একজন মানুষ। দাদার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে না পারলেও সে পরিস্থিতি পাল্টাতে বুদ্ধির প্রয়োগ করতে পারে।
শ্যামাসুন্দরী: শ্যামাসুন্দরী সম্পর্কে মধুসূদনের ভ্রাতৃবধূ। বিধবা শ্যামাসুন্দরী প্রথম থেকেই মধুসূদনের প্রতি দুর্বল। মধুসূদনের থেকে যথাযথ সম্মান না পেলেও তার প্রতি দুর্বলতা কাটাতে পারে না।
পাঠ প্রতিক্রিয়া: যোগাযোগ সামাজিক উপন্যাস হলেও এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাস থেকে ভিন্ন। এতে অঙ্কিত হয়েছে ব্যক্তির হৃদয়বৃত্তি ও মানসদ্বন্দ্ব, যেটি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিফলিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত এই উপন্যাস যেন বর্তমান আবহেও একইরকম গ্রহণযোগ্য। বংশে বংশে দ্বন্দ্ব, প্রতিশোধপরায়ণতা ভবিষ্যৎ সম্পর্কগুলোকে কীভাবে এলোমেলো করে দিতে পারে এটি তার রূপায়ণ। দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র এতে উঠে এসেছে। এছাড়া ভাইবোনের সম্পর্ক কতটা সিগ্ধ, মধুর হতে পারে সেটার বড় উদাহরণ বিপ্রদাস ও কুমু। এই উপন্যাসে আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র বিপ্রদাস। উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল এক আদর্শ দাদা। কুমুদিনীর মধ্যে অতি দেবতা ভক্তি ও ভাগ্য বিশ্বাস কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করেছে। তবে কুমুদিনীর মধ্যে এক অন্যরকম সিগ্ধতা আছে যেটা পাঠককে শেষপর্যন্ত আকর্ষণ করবে। মধুসূদনের প্রভুত্ব আর শ্যামাসুন্দরীর আত্মমর্যাদাহীন আচরণ দেখে খুবই রাগ হয়েছে। সামগ্রিক দিক থেকে বললে, যোগাযোগ মানসদ্বন্দ্বের পাশাপাশি নারী স্বাধীনতার কথাও বলে। লিখনশৈলী, ঘটনা, চরিত্রচিত্রণের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বললে ভুল হবে না।
প্রিয় কিছু উক্তি:
📖”কিন্তু আরম্ভের পূর্বে ও আরম্ভ আছে, সন্ধ্যের দীপ জ্বালানোর পূর্বে সলতে পাকানো”।
📖” ঘা-খাওয়া বংশ, ঘা-খাওয়া নেকড়ে বাঘের মত, বড়ো ভয়ংকর।”
📖”এইরকম জন্ম-একলা মানুষদের জন্যে দরকার মুক্ত আকাশ, বিস্তৃত নির্জনতা, এবং তারই মধ্যে এমন একজন কেউ, যাকে নিজের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভক্তি করতে পারে।”
📖”যুক্তির দ্বারা সংসারে দুঃখ ঠেকানো যায় না।”
📖”মস্ত এই পৃথিবী, এর মধ্যে কোনো-এক জায়গায় আমারও একটুখানি ঠাঁই হতে পারবে। জীবনে অনেক যায় খসে, তবুও কিছু বাকি থাকে।”
📖”ক্ষমতা জিনিসটা যেখানে পড়ে-পাওয়া জিনিস, যার কোনো যাচাই নেই, অধিকার বজায় রাখবার জন্যে যাকে যোগ্যতার কোনো প্রমাণ দিতে হয় না, সেখানে সংসারে সে কেবলই হীনতার সৃষ্টি করে।”
বইয়ের নাম:যোগাযোগ
লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধরণ: সামাজিক
প্রকাশকাল: ১৯২৯(আষাঢ়, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ)
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৪৪
মুদ্রিত মূল্য : ১৮০
ব্যক্তিগত রেটিং: ৮/১০