বই : ফেরা pdf
লেখক : সিহিন্তা শরীফা, নাইলাহ আমাতুল্লাহ
জনরা : অনুপ্রেরণামূলক / মুসলিম ব্যক্তিত্ব
প্রচ্ছদ : সিদ্দিকী সানজিদা সাঈদ কথা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১২০, credit- Mohammad Jahedul Islam
মুদ্রিত মূল্য : ১৭২ টাকা
প্রকাশনা : সমকালীন প্রকাশন
“ফেরা” দুই খ্রিষ্টান বোনের ইসলামের পথে ফিরে আসার সত্য গল্প। সঠিক ধর্মের সন্ধান পাওয়ার পর যেসব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেগুলো নিয়েই “ফেরা” র গল্প। বইয়ের কথাগুলো কখনো শিহরিত করবে আবার কখনো নিজের অজান্তে দু’চোখে জলপ্রপাত বয়ে দেবে।
কাহিনী সংক্ষেপ :
মেয়েটির মনে শৈশবে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সাথে জন্ম নিয়েছিল খ্রিষ্টধর্মের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। ছেলেবেলায় পরিবার, স্কুল আর বিভিন্ন বইপত্র থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যে মুসলিমরা খারাপ আর তারা ভালো। ধর্ম ক্লাসে ওদের বিরুদ্ধে প্রায়ই শুনতে হতো। ওরা হলো ক্ষতিকর লাল পিঁপড়া আর তারা নিরীহ কালো পিঁপড়া।
নিয়মিত গির্জায় যাওয়া, চার্চের ফাদারের কাছে গিয়ে পর্দার আড়ালে হাঁটু গেড়ে নিজের পাপ স্বীকার করা, নিয়মিত ধর্ম ক্লাসে যাওয়া, প্রচুর ধর্মের বই পড়া, নিজেকে খ্রিষ্টান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করা, শৈশব-কৈশোরে ধর্মপরায়ণ হওয়া, খ্রিষ্টবাদ যার রক্তে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে কৈশোর পেরিয়েও সে মেয়েটি কখনো মাথা ঘামানোর প্রয়োজনবোধ করেনি যেই ধর্ম মানছে সেটা সত্য নাকি মিথ্যা। অনেক সময় মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন এসে উঁকিঝুঁকি মারত। হিসেব মেলাতে পারতো না কিছু প্রশ্নের উত্তরের।
একবার বাইবেলের গল্প নিয়ে একটি বই পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করল শুরুতেই সৃষ্টির বর্ণনায় ভুল রয়েছে। আগে থেকেই অন্য ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল, এবার নিজের ধর্ম সম্পর্কে ধারণাও বদলে যেতে
শুরু করলো। নেমে পড়লো জীবনের আসল উদ্দেশ্য খোঁজার পেছনে। যেই উদ্দেশ্যের পেছনে ছুটে চলেছে সেই উদ্দেশ্যটাই একসময় তার জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিল। দিল এক নতুন প্রশান্তিময় জীবন। এই জীবনের স্বাদ যে কী তা যে পায়নি সে কখনোই বুঝবে না।
এ জীবনের স্বাদটুকু মেয়েটি একা নেয়নি। নিজের দেড় বছরের ছোটবোনকেও স্বাদটা গ্রহণ করিয়েছে। একসময় যে মেয়েটি হাল ফ্যাশনের পোশাক পরতো, ফ্যাশন করে চুল কাটতো, ম্যাচিং কানের দুল, হাতে চুড়ি, চুলে ক্লিপ, রং-বেরঙের নেইল পলিশ দিতো; সে মেয়েটি বোনের মাধ্যমে ইসলামী জীবনের স্বাদ গ্রহণ করার পর এসব অভ্যাস পুরোপুরি ত্যাগ করে দিয়েছে। আল্লাহর কাছে নিজেদের পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে দেওয়ার পরও গোপনে ইসলাম ধর্ম পালন করতে হতো। এভাবে আর কত? শুরু হয় বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম পালন করার লড়াই।
পাঠ – প্রতিক্রিয়া :
ফেরা পড়ে কেমন লেগেছে? এত ভালো লেগেছে যে টানা দুইবার গোগ্রাসে গিলেছি। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়ানো ছিটানো ছিল উপলব্ধি করার মতো উপকরণ। বইয়ের কথাগুলো মনের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে দিয়েছে। কিছু কথা প্রবলভাবে অন্তরকে আবেগপ্রবণ করে দিয়েছে। কিছু কথা মস্তিষ্কের ভেতর ভাবনার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিছু কথা ভালো লাগার এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দুইবোন নিজেদের সত্য ঘটনাগুলো এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যা অভূতপূর্ব।
আমরা যারা ইসলামকে জন্মগতভাবে পেয়েছি, তারা বাস্তব জীবনে কতটুকুই বা ইসলামকে অনুসরণ করে চলছি? ধর্ম সম্পর্কে, স্রষ্টা সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি? সব ধর্মের মানুষেরাই তো বাপ-দাদাদের ধর্মকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে আসছি। মানতে হবে তাই মানছি। ধর্মগ্রন্থ কী বলছে তা কী শুনছি? ধর্ম সম্পর্কে জানার প্রয়োজনবোধ করছি না বলে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ না করার ফলে আমাদের জন্য বিচার দিনে কত ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে তা কি জানি?
যে মেয়েটি একসময় মুসলিমদের তীব্র ঘৃণা করতো, মাইকে আযান শোনার সময় ব্যঙ্গ করে গাইতো; আর সেই মেয়েটির উপরই কিনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমনভাবে হেদায়েত দিয়েছেন যার কারণে মেয়েটির মনে আল্লাহর প্রতি এত তীব্র ভালোবাসা ও বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে নিজের খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের পথে আসতে বাধ্য হলো। এটাও আল্লাহ তা’আলার একটা নিদর্শন। কোনো মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ সঠিক ধর্মকে সে বেছে নেয়নি। নিজেই স্রষ্টা সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে জানতে গিয়ে আসল ধর্মকে খুঁজে পেয়েছে। আর এসবের মাধ্যম ছিল – বইপত্র ও ইন্টারনেট। সত্য ধর্মকে খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে আলোর পথে নিজে একা আসেনি, সাথে নিজের ছোটবোনকেও নিয়ে এসেছে। ভেবে দেখুন, এটা আল্লাহর কত বড় নিয়ামত।
জন্মগতভাবে ইসলামকে না পাওয়ার পরও সত্য ধর্মকে খুঁজতে গিয়ে ইসলামকে খুঁজে পেয়েছিল দু’বোন। নিজেদের খ্রিষ্ট ধর্ম, সমাজ, পরিবারের মানুষদের বিরুদ্ধে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার কাছে পুরোপুরিভাবে নিজেদের আত্মসমর্পণ করে দিয়েছিল। আল্লাহকে এতই ভালোবেসে যে নিজেদের হারাম অভ্যাসগুলো পর্যন্ত ত্যাগ করেছিল। ধর্মান্তরিত মুসলিম হওয়ার পরও প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম পালন করতে না পারার জন্য যে কষ্ট পোহাতে হয়েছিল তাতেও দমে যাননি তারা। গোপনে বাসার ছাদে গিয়ে আবছা অন্ধকারে এক কোণায় দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা, সিয়াম রাখার জন্য বুকশেলফে শুকনো খাবার আর খেজুর লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে ফুটে ওঠে আল্লাহর প্রতি তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। দু’বোন স্বেচ্ছায়, নিজেদের স্বার্থে, শান্তি লাভের প্রত্যাশায় যেসব ত্যাগ স্বীকার করেছে সেসব ত্যাগের মাধ্যমে অন্তরে যে প্রশান্তি লাভ করেছে তা সত্যিই অতুলনীয় ও অভাবনীয়।
ইসলামের মতো প্রশান্তিময় জীবন আর কোথায় বা আছে! এ জীবনের স্বাদ তো সবাই পায় না। সেদিক থেকে মুসলিমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যেসব নামধারী মুসলিম পথভ্রষ্ট হয়ে ঈমানের পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবার তাদের নীড়ে ফেরা উচিত। অন্তত পরকালে জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় হলেও আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করা উচিত।
লেখক ও সম্পাদনা :
লেখক-দ্বয় ইসলামের পথে ফিরে আসার সত্য গল্প দুটো এত সুনিপুণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রেখেছিল। বাচনভঙ্গির প্রাঞ্জলতা গল্প দুটোকে আর বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। পুরো বই জুড়ে সাহিত্যের একটা আবহ বিরাজমান ছিল। দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো একটি বই।
বইয়ের সম্পাদনার পেছনে যে মানুষটা ছিল ওনাকে আলাদাভাবে ধন্যবাদ দিতেই হয়। খুব যত্নসহকারে সম্পাদনা করেছেন। বইয়ে অনেকগুলো টীকা দিয়েছেন যাতে সবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ ও ব্যবহার সম্পর্কে জানতে সুবিধে হয়।
প্রচ্ছদ, বানান, মলাট, বাঁধাই :
প্রচ্ছদটা সাদামাটা হলেও এর মধ্যে নান্দনিকতার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। প্রচ্ছদে দেখা যায় একটা পাখি নীড়ে ফিরছে। বাহ! অসাধারণ তো। বইয়ের মূল থিমের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচ্ছদ। টাইপোগ্রাফিটাও বেশ আকর্ষণীয়। যতবার এর উপর হাতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছি ততবারই সমস্ত শরীরে এক শীতল প্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল।
বইয়ের কিছু ভুল বানান – অনেক্ষণ, সত্ত্বা, পেড়িয়ে, আয়াহ, চাকরিজীবি। এছাড়া আর আর তেমন ভুল বানান নজরে পড়েনি। বইটি পেপারব্যাক হলেও মলাট আর বাঁধাই যথেষ্ট রকমের ভালো ছিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
ধন্যবাদ।
“জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী ভালো মানুষের হোক।”.