মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা ৫০০ শব্দ (২০০ শব্দ)

bookishbd মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা ৫০০ শব্দ ২০০ শব্দ 2

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর পিতার নাম আব্দুল্লাহ আর মাতার নাম আমিনা। এখানে মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা ৫০০ শব্দ, ৩০০ শব্দেরও বেশী pdf ও তাঁর পুরো পরিচয় বর্ণনা করা হলো-

  • নামঃ মুহাম্মাদ মুস্তফা
  • উপনামঃ আবুল কাসেম
  • উপাধিঃ আল আমিন
  • গোত্রঃ কুরাইশ
  • বংশঃ হাশেমী
  • জন্মঃ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার, ৫৭০ খ্রিঃ
  • জন্মস্থানঃ মক্কা
  • জন্ম সময়ঃ রাত অতিবাহিত হয়ে প্রত্যুষে
  • পিতাঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব
  • মাতাঃ আমিনা বিনতে ওয়াহহাব
  • দুধ মাতাঃ হালিমা
  • দাদাঃ আব্দুল মুত্তালিব
  • দাদিঃ ফাতিমা
  • নানাঃ ওয়াহহাব বিন আবদে মানাফ
  • নানিঃ বোররা বিনতে ওমজা

 হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম তারিখ

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার। শুক্লা দ্বাদশীর অপূর্ণ চাঁদ সবেমাত্র অস্ত গিয়েছে। সুবহে সাদিকের সুখ-নূরে পূর্ব  আসমান রাঙা হয়ে উঠেছে। আলো আঁধারের দোল খেয়ে ঘুমন্ত প্রকৃতি  আঁখি মেলেছে।

বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব তখন কাবাগৃহে বসে আপন গোত্রের লোকদের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এমন সময় সংবাদ আসল যে, আমিনা এক পুত্ররত্ন প্রসব করেছেন। হর্ষ  ও বিষাদে আবদুল মুত্তালিবের হৃদয় ভরে গেলো।

সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি আমিনার গৃহে উপস্থিত হয়ে আব্দুল্লাহ তনয়ের মুখ দর্শন করলেন। কী সুন্দর জ্যোতির্ময় বেহেশতী মুখশ্রী! আব্দুল মুত্তালিবের চোখ জুড়িয়ে গেলো। আকুল আগ্রহে শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ কাবা প্রাঙ্গণে এসে তার জন্য প্রার্থনা করলেন।

সাতদিন পরে আরবের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আবদুল মুত্তালিব শিশুর আকিকা উৎসব করলেন। মক্কার বিশিষ্ট কোরেশ নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেয়া হলো। উৎসব শেষে কোরেশ দলপতিগণ জানতে চাইলেন- শিশুর নাম কী রাখলেন?

“মুহম্মাদ”- কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে আব্দুল মুত্তালিব এই কথা বলে ফেললেন। সকলে শিশুকে আশির্বাদ করে চলে গেলেন।

মহানবী সাঃ এর শৈশবকাল রচনা

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জন্মের কয়েক দিন পরেই মরুভূমি হতে বেদুঈন নারীরা শিশু সন্তানের অনুসন্ধানে মক্কা নগরীর উপনীত হলো। তখনকার দিনে আরবে এটাই ছিল প্রচলিত প্রথা। সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার স্তন্যদান এবং লালন-পালনের ভার ধাত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হতো। অবশ্য এজন্য ধাত্রীকে উপযুক্ত পুরস্কার ও বেতন দেয়া হত।

ধাত্রীদের সকলেই মনের মত এক একটা শিশু সন্তান লাভ করে ফিরে গেল। কিন্তু মোহাম্মদ ছাড়া অন্য কোনো শিশু হালিমার ভাগ্যে জুটলোনা। তখন হালিমা স্বামীকে ডেকে বললেন- শূন্য হাতে ফিরে গিয়ে লাভ কি? এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করি, কী বল?

স্বামী উত্তর দিলেন- নিশ্চয়ই, মোহাম্মদকে গ্রহণ করো। ইহার মধ্য দিয়ে আমাদের নসিব বুলন্দ হইবে। হালিমা তখন শিশু মোহাম্মদকে গ্রহণ করলেন।

হালিমার এক পুত্র, তিন কন্যা ছিল। পুত্রের নাম আব্দুল্লাহ এবং কন্যার নাম আনিসা,হোজায়ফা এবং শায়েমা। শায়েমার বয়স তখন সাত-আট বছরের মত। শিশু মুহাম্মাকে লালন-পালনের কাজে সে সর্বদা মাকে সাহায্য করতো। মুহাম্মাদকে সে বড় ভালোবাসতো।

শিশু মুহাম্মাদকে নিজ গৃহে আনার পরে হালিমা এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তার গৃহপালিত’ পশুগুলি অধিকতর পরিপুষ্ট হয়ে উঠলো এবং অধিক পরিমাণে দুগ্ধদান করতে লাগলো। খেজুর বৃক্ষে প্রচুর পরিমাণে খেজুর ফলতে লাগল। কোন দিক দিয়ে তার আর কোন অভাব অনুভব হল না।

এভাবে দুই বছর কেটে গেল। হালিমা মোহাম্মদকে আমিনার নিকট নিয়ে আসলেন। আমিনা পুত্রের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মধুর মুরতি ও দিব্যকান্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। হালিমার উপরেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন।

এই সময় মক্কায় অত্যন্ত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হলো। এ কারণে আমিনা মুহাম্মদকে আরো কিছুদিন হালিমার তত্ত্বাবধানে রেখে দেওয়া সঙ্গত মনে করলেন। বৃদ্ধ মুত্তালিবও এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন। পুনরায় মোহাম্মদ  হালিমার গৃহে ফিরে চললেন।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনী

হালিমার গৃহে অবস্থান কালে হযরত মুহাম্মদ এর জীবনে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটেছিল। একদিন শিশু মোহাম্মদ তাঁর  দুধভাই ও অন্যান্যদের সাথে মাঠে মেষ চড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একজন ফেরেশতা তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। মোহাম্মদের হাত ধরে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন।

তারপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তার বুক চিরে কি যেন বাহির করলো। মুহাম্মদ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন। দূর থেকে এই ব্যাপার লক্ষ্য করে বালকেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে হালিমাকে বললেন- দেখ গিয়ে মোহাম্মদ নিহত হয়েছেন। সংবাদ পেয়ে হালিমা এবং তার স্বামী ছুটে এলেন। দেখলেন বাস্তবিকই মুহাম্মাদ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তারা কিছুই বুঝতে পারলেন না।। মূলত এটি ছিল তাঁর সিনা সাফ করার একটি ঘটনা।

মহানবী সাঃ এর স্ত্রীদের নাম

হযরত মুহাম্মাদ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় মোট ১৩টি বিবাহ করেছেন। বিবি খাদিজা ছাড়া আর বাকি ১২টি বিবাহ করেছেন ৫১-৬৩ বছর বয়সের মধ্যে, বিবি খাদিজার মৃত্যুর পরে। এক সুমহান আদর্শ ও প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এতগুলি বিবাহ করেছিলেন। নারীত্বের মর্যাদা দান, পরিজনদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অর্জন, অনুরোধ রক্ষা, আদর্শের পূর্ণতা সম্পাদন, কু-সংস্কারের উচ্ছেদ সাধন, আত্ম-ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করার জন্যই মূলত তিনি একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

হযরত মুহাম্মাদ (স.) জীবনে যে সকল নারীকে বিবাহ করেছেন তাদের নামের তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং হযরত কোন বয়সে কাকে বিবাহ করেছেন তা নিন্মে দেখানো হলো-

১। খাদিজা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ২৫ বছর

২। সাওদা- ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫১ বছর

৩। আয়েশা- কুমারী- হযরতের বয়স তখন ৫২ বছর

৪। হাফসা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৪ বছর

৫। জয়নাব বিনতে খোজাইমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৬। উম্মে সালমা ( বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৫ বছর

৭। জয়নব (জায়েদের পরিত্যক্তা স্ত্রী)  – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৮। জওয়ায়েরা ( বিধবা, বনি মুন্তালিক গোত্র) – হযরতের বয়স তখন ৫৬ বছর

৯। রায়হানা (ইহুদিনী, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১০। মেরী (খ্রিষ্টান, অপহৃতা,  বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৭ বছর

১১। সফিয়া ( কিনানার স্ত্রী, বিধবা, ইহুদিনী) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১২। উম্মে হাবিবা (আবু সুফিয়ানের কন্যা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৮ বছর

১৩। মায়মুনা (বৃদ্ধা, বিধবা) – হযরতের বয়স তখন ৫৯ বছর

শ্রেষ্ঠ মানুষ : মহানবী হজরত মুহম্মদ (স) – এর জীবন ও জীবনাদর্শ

ভূমিকা :

 সমাজ জীবনে যখন বিশৃঙ্খলা উত্তঙ্গ, কুসংস্কার ও বিচ্ছিন্নতার অশুভ প্রেতনৃত্যে যখন চতুর্দিক আচ্ছন্ন, পরিবেশ যেখানে বিষাক্ত ও কলুষিত, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যখন অবক্ষয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট, অজ্ঞানতার তামসিকতায় মানুষ যখন সুপ্তিমগ্ন, দিশেহারা; তখনই আদর্শভ্রষ্ট মানুষকে তার হতাশা থেকে, রুদ্ধশ্বাস অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে ধরাধামে আবির্ভাব ঘটে জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের। সত্যের জ্যোতিতে বিশ্বলোক হয় উদ্ভাসিত। তাঁদের আদর্শ ও সত্য-দৃষ্টি বিভ্রান্ত মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে। করে নিত্য-নতুন কল্যাণবোধে উদ্দীপ্ত। এমনি করেই যুগে যুগে কত মহাপুরুষের পুণ্য আবির্ভাবে, অসহায়-পঙ্গু-দুর্বল মানুষ খুঁজে পেয়েছে অন্ধকারে আলো, হতাশায় আশ্বাস, দুঃখে সান্ত্বনা। মধ্যযুগের আরব জাতির জীবনও ছিল এরকমই হতাশা, কুপ্রথা, মূর্তি পূজা, কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন। জড়তাগ্রস্ত, হতাশাচ্ছন্ন ও অন্ধ-তামসিকতামগ্ন আরবজাতিকে মুক্তি দিতে এলেন আল্লাহ-প্রেরিত মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত হজরত মুহম্মদ (স)। পৃথিবী হল আলোকময়।

হজরত মুহম্মদ (স) ৩০০ শব্দ:

 হজরত মুহম্মদ (স) মহান আল্লাহ-প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহম্মদ (স)। তিনি মানুষের আলোর দিশারি। মানুষের মুক্তি, শান্তি, শিক্ষা ও কল্যাণের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন।

জন্ম ও বাল্যজীবন :

 ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৪ আগস্ট (১২ রবিউল আউয়াল), সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর হাবীব, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও বিশ্বের আশীর্বাদ হজরত মহম্মদ (স) আরবের এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমেনা। তাঁর জন্মের পূর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। শিশুনবী মহম্মদ (স)-এর ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা হজরত আমেনা ইন্তেকাল করেন। তারপর শিশুনবী পিতামহ আব্দুল মোত্তালিবের স্নেহের ছায়ায় বড় হতে লাগলেন। দাদার স্নেহ-আদরে শিশুনবী পিতামাতার অভাব অনেকটা ভুলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস, দাদা মোত্তালিব তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন ৮ বছরের নাতী শিশুনবীকে ত্যাগ করে মানবলীলা সংবরণ করেন। এরপর পিতৃব্য আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শৈশব, কৈশরের সততা, কোমল স্বভাব ও অপরিসীম কর্তব্যবোধ, অকৃত্রিম সাধুতা প্রভৃতি গুণাবলির জন্যে তাঁকে সর্বশ্রেণীল লোকজন ‘আল-আমীন বা বিশ্বাসী, উপাধিতে ভূষিত করেন।

বিবাহ :

মক্কার ধনবতী বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা (রা) যুবক নবীর সুখ্যাত্বির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে নিজ ব্যবসায়ের দায়িত্বভার প্রদান করেন। ক্রমশ তাঁর বিশ্বস্ততার প্রতি অনুরক্ত হয়ে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হজরত মুহম্মদ (স) এর বয়স যখন ২৫ বছর তখন তিনি ৪০ বছর বয়স্ক বিবি খাদিজার সঙ্গে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।

নবুয়ত প্রাপ্তি :

 চল্লিখ বছর বয়সে একদিন যখন হেরা পর্বতের গুহায় হজরত মুহম্মদ (স) আল্লাহর গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন, এমন সময় আল্লাহর আদেশানুসারে ফেরেশতা জিবরাইল (আ) তাঁকে নবুয়তের খোশ খবর দিয়ে অহি অর্পণ করেন। যা তিনি পরবর্তীতে আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরানের আকারে মানব সমাজে প্রচান করেন এবং আল-কোরান তাঁর উপরে নাজিল হওয়ার পর থেকে তিনি নবী বা রসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। পরবর্তীতে মহম্মদের আদর্শের সাথে একাত্ব ঘোষণা করে কোরানকে যারা স্বীকার করে নেয়, তারা মুসলমান হিসেবে পরিচিত হয়।

ইসলাম প্রচার :

 অহি প্রাপ্তির কিছুদিন পর তিনি আল্লাহর আদেশ প্রাপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা)-ই হলেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত প্রথম নারী-মুসলমান। তারপর ইসলাম গ্রহণ করেন কিশোর হজরত আলী (রা) এবং যায়েদ-বিন-হারেস। ক্রমে নবীর আদর্শে উদীপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। অন্যদিকে, বিধর্মী কোরাইশগণ ক্ষীপ্ত হয়ে নবীজী ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে নানারকম অত্যাচার ও উৎপীড়ন শুরু করে দিল। এতদ্সত্ত্বেও ইসলামের জয়যাত্রাকে অক্ষুণ্ণ রেখে তাঁরা তাঁদের সত্যপথ থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়ান নি। বিধর্মীরা ইসলামের প্রসার দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। একদিন তারা একত্রিত হয়ে পরামর্শ করে যে, তারা হজরত মুহম্মদ (স) কে হত্যা করে তাঁরা প্রবর্তিত ইসলাম ধর্ম প্রচার স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু বিধর্মী কোরাইশ নেতাদের মনষ্কামনা কখনো পূরণ হয় নি।
 

মদিনায় হিজরত :

 কোরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবী আল্লাহর আদেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমন করেন। মহানবীর এই মদিনা গমনকেই ‘হিজরত’ বলা হয়। মদিনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব। হজরত মুহম্মদ (স)-এর মদিনায় আগমনের পর তাঁর সম্মানার্থে এর নাম রাখা হয় ’মদিনাতুন্নবী’ এবং যে-সব মদিনাবাসী তাঁদের আশ্রয় ও সাহায্য করেছিলেন তাঁদেরকে ‘আনসার’ বলা হয়।

মদিনার সনদ :

হজরত মুহম্মদ (স) মুসলমান ও বিধর্মী ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্যে এবং মদিনার রক্ষাকল্পে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে যে সনদ প্রস্তুত করেন তা ‘মদিনার সনদ’ নামে খ্যাত। এই সনদকে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (স) শুধু ধর্ম প্রচারকই ছিলেন না, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদও ছিলেন।

কয়েকটি যুদ্ধ :

 মদিনায় ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং হজরত মুহম্মদ (স) এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মক্কার কোরাইশগণ শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারে বিধর্মীরা ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিধর্মীরা প্রায় সবগুলো যুদ্ধেই পরাজয়বরণ করে। অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হজরত মুহম্মদ (স)-এর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে কোন জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উচ্চ-নিচ এবং ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। এজন্যেই মহান আল্লাহপাকের এই ধর্ম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠধর্ম হিসেবে শেষ অবধি টিকে আছে এবং আজীবন টিকে থাকবে।

মহানবীর জীবনাদর্শ

১। চরিত্র : 

বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (স) মানবকুলের আদর্শ পুরুষ। তিনি দিব্যকান্তিবিষিষ্ট সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। তাঁর অবয়ব থেকে প্রতিভা ও দৃঢ়সংকল্পের যে জ্যোতি স্ফুরিত হত তা সবাইকে মুগ্ধ করত। তাঁর বাক্য এমন কোমল মধুর ও মনোহর ছিল যে, শত্রুরা পর্যন্ত তাঁর আকর্ষণীয় শক্তি অনুভব করে বলতো, “মুহম্মদের বাক্যে ইন্দ্রজাল আছে।” তিনি যেমন আধ্যাত্মিক বিষয়ে তেমনি বাহ্য-বেশ-বিন্যাসের ও আদর্শ স্থানীয় ছিলেন। হজরত মুহম্মদ (স) এমন শিষ্টাচারী ছিলেন যে, কারো সঙ্গে দেখা হলে তিনিই অগ্রবর্তী হয়ে সালাম দিতেন।

২। স্নেহপরায়ণতা :

মহানবী হজরত মুহম্মদ (স) ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে অত্যন্ত আদর করতেন, তাদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলতেন এবং সময় সময় তাদের সঙ্গে খেলাও করতেন। একবার নামাজের সিজদা দিবার সময় তাঁর দৌহিত্র শিশু হুসাইন তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসেছিলেন। হুসাইনের নেমে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করে তবে সিজদা থেকে মস্তক উত্তোলন করেন। তিনি অনেক সময় নিজে উট সেজে হাসান-হুসাইনকে সেই উটে চড়াতে ভালবাসতেন।

৩। আত্মসম্মানবোধ :

 মহানবীর আত্মসম্মানবোধ অতিপ্রবল ছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন। একসময় এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে একখানা কুঠার দান করে বলেছিলেন, “এটা নিয়ে কাঠ কেটে তাই বিক্রি করে জীবন ধারণ করবে।” এছাড়া, তিনি কারো দান গ্রহণ করতেন না। পারস্য দেশের এক কৃষক সন্তান সালমান নবীজীর এই মহান গুণ দেখে তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

৪। বৈশিষ্ট্য :

 “মানুষ মানুষের ভাই, পরস্পর সমান” -এই নীতিবাক্য তিনি কেবল মুখেই প্রচার করেন নি, কার্যেও তার ভুরি ভুরি প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তিনি দাস-দাসীর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করতেন, তাদেরও তেমনি সেবা করতেন। অনেক সময় দাসকে উটে চড়িয়ে নিজে পদব্রজে চলতেন।

৫। চরিত্রিক দৃঢ়তা :

 হজরত মুহম্মদ (স) ছিলেন সংকল্পে অটল, অবিচল; কোন প্রকার লোভ, অত্যাচার, ক্ষমতা-মোহ কিছুই তাঁকে সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি এবং সমুদয় বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজের জীবনকে তাই তিনি সুষমামণ্ডিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর অন্তঃকরণে ছিল দুর্জয় সাহস বিপৎপাতে অসীম ধৈর্য, বিপন্মুক্তিতে চিত্তপ্রসাদ -এসব মহৎ গুণের প্রভাবেই তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন।

৬। ক্ষমা :

 ক্ষমার প্রশ্নে মুহম্মদ পৃথিবীর বুকে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর প্রাণঘাতী শত্রুকে পর্যন্ত বারবার হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি তাদের ক্ষমার স্নিগ্ধ স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেন নি। মক্কা বিজয়ে প্রাক্কালে যখন শত্রুপক্ষ প্রাণের আশঙ্কায় বিচলিত, মুহম্মদ তাঁর চিরাচরিত স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তাদের সবাইকে ক্ষমা করে বিশ্বের দরবারে ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

৭। সংস্কার :

 মুহম্মদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সার্থক এবং বিপ্লবী সংস্কারক। তিনিই তার সমাজের অচলায়তন জীর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলেন। লুপ্ত নারী মর্যাদাকে উদ্ধার করে তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দান করেন। নারীর শাশ্বত মাতৃত্বের পবিত্রতা ও গৌরব তিনিই প্রথম প্রচার করেন। ঘোষণা করেন, জননীর পদতলে সন্তানের মুক্তি।

৮। মহানবীর ওফাত :

 আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী দো-জাহানের সর্দার হজরত মুহম্মদ (স) ৬৩ বছর বয়সে একাদশ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন) সোমবার দ্বিপ্রহরে নামাজরত অবস্থায় ইহজগতের মানুষকে শোকসাগরে ভাসিয়ে জান্নাতবাসী হন।

উপসংহার :

 বিশ্বনবী, মহাসাধক, মহাজ্ঞানী হজরত মুহম্মদ (স) ছিলেন একাধারে সমাজসেবক, সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, ধর্মপ্রবর্তক ও সাম্রাজ্য স্থাপক। আরবের শতধা বিভক্ত, যুদ্ধরত বর্বর গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে এক জাতি, এক রাষ্ট্র ও সর্বকালের উপযোগী এক পবিত্র অলঙ্ঘনীয় বিধান প্রতিষ্ঠা করে তিনি মানব সমাজকে নব জীবন দান করেন। শুধু মুসলমানদের দৃষ্টিতেই নয়, আলফ্রেড দ্য লামার্টিন, জন উইলিয়ম ড্রেপার, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখ অসংখ্য অমুসলিম মনীষী কর্তৃকও হজরত মুহম্মদ (স) সর্বশ্রেষ্ট মহামানব ও প্রথিবীর সর্বাপেক্ষা সফলকাম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *