দুই মুসাফির Pdf Download
আরও পড়ুন:
বইঃ গল্পটি শুনতে চেও না।
লেখকঃ সোহেল নওরোজ
প্রচ্ছদঃ সোহানুর রহমান অনন্ত
প্রকাশনাঃ দেশ পাবলিকেশন্স
প্রকাশকালঃ ২০১৯
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০
আকাশে কমলা রঙের চাঁদ উঠেছে। কুয়াশার ভারি পর্দার ভেতর দিয়ে চাঁদটাকে দেখতে কষ্ট হচ্ছে না তবে অস্বস্তি লাগছে। এই রাত রঙিন কিছু দেখার জন্য উপযুক্ত না। হাফিজুল হকের গায়ে কালো রঙের চাদর। রাতের অন্ধকারে কালাে রঙ সহজে মিশে যায়, সাদা মেশে না। তিনি অন্ধকারে মিশে যাওয়ার জন্যই ঘর থেকে পা বাড়িয়েছেন। যে জীবন এতদিন বয়ে নিয়ে এসেছেন তাতে মিশে থাকা অন্ধকার হঠাৎ করেই প্রতিভাত হয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। এটাই হয়তো নিয়তি! সময় কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় আগে থেকে কেউ জানে না। তিনিই এখন তার উপন্যাসের অচ্ছুৎ এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন। সারা জীবন গল্প বলে যাওয়া মানুষটা নিজের গল্প কাউকে বলতে পারছে না– এরচেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে!
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
কিছু গল্প এমন থাকে যেগুলো শোনার পর মনে হয় যে গল্পটা না শুনলেই ভালো হতো, গল্প শেষে হাহাকার কাজ করে। কিছু গল্প এমন থাকে যেগুলো গল্পকথক বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, “গল্পটি শুনতে চেও না” এই দুই ক্যাটাগরির মাঝের কিছু একটা হবে হয়ত৷
সোহেল নওরোজ এর সম্ভবত আরো বেশ কিছু বই এর আগে বেরিয়েছে। তবে তার লেখা এই প্রথম ই পড়া। এই গল্প পড়ার পেছনে গল্পের নামটা ই বেশী আকর্ষন সৃষ্টি করেছে। লেখকের ভাষ্যমতে এই গল্প লেখা শেষ করতে নাকি তার আড়াই বছর সময় লেগেছে।
গল্পটি শুনতে চেয়ো না বইটি আহামরি কোনো গল্প না, খুবই সাধারণ গল্প। একজন লেখকের গল্প লিখতে শুরু করার সময় নাহিদ নামের এক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটান, এরপর নিজেকেও জড়িয়ে ফেলেন গল্পে, হয়ে উঠেন গল্পের চরিত্র।
সোহেল নওরোজ এর স্টোরিটেলিং মোটামোটি, তবে লেখকের বাক্যগঠন বেশ ভালো৷ সবচেয়ে স্ট্রং জায়গা হলো লেখকের জীবন দর্শন। পুরো বইয়ের প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় তার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। গল্পের চরিত্র গুলো বিল্ড আপ করতে গিয়ে অনেক সময় নিয়ে ফেলেছেন লেখক৷ অযথা বেশ কিছু কথা জুড়ে দিয়েছেন যা না করলেও পারতেন৷ শুরুর দিকে গল্পটা অনেক স্লো, প্রথম ৪০ পৃষ্ঠা পড়তে প্রায় বিরক্ত চলে এসেছিলো। এরপর আস্তে আস্তে গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছি৷ জানার আগ্রহ হতে থাকলো এরপর কি হয়৷ শুরুর দিকে যতটা ধীর গতিতে শুরু করেছেন, শেষে এসে ততটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিয়েছেন। শুরুতে বলেছিলাম আহামরি কোনো গল্প না। তবে গল্পটা শেষের দিকে পড়তে বেশ ভালো লাগছিলো। গল্পের প্রতি একটা টান অনুভব করছিলাম। শেষেও কিছুই জায়গায় খাপছাড়া রেখে দিয়েছেন, কয়েকটা জিনিস এড়িয়ে গেছেন। তবে গল্পভাবনা টা চমৎকার। লেখকের ভুল ত্রুটি গুলো কে এক সাইডে ফেলে রেখে, যেটুক ভালো লাগা সেটুক কে ধরে নিজেকে তৃপ্ত করেছি। ভালোই লেগেছে গল্পটা। একেবারে খারাপ কোনো গল্প না আবার একেবারে অসাধারণ কিছুও না। গল্পটা শেষ করে ভালো লাগা, হাহাকারের মিশ্র এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
বইয়ের প্রোডাকশন বেশ ভালো, বাইন্ডিং শক্তপোক্ত আছে। পৃষ্ঠাগুলোও যথেষ্ট মোটা। বানান ভুল ও খুব একটা চোখে পড়েনি।
বইয়ের প্রচ্ছদ টা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। একদম সিম্পল একটা প্রচ্ছদ, নামলিপির সাথে প্রচ্ছদের মেইন কালার টার কম্বিনেশন বেশ ভালো।
এই বইয়ে অনেকগুলো পছন্দের লাইন ছিল তার কয়েকটা –
★ রুটিন মানা মানুষ অনেকটা চিরতার পানির মতো। ফল ভালো হলেও স্বাদ তিক্ত।
★ মস্তিষ্ক হুট করে কিছু তৈরি করতে চায় না। পুরনো কোনো বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য খোঁজে।
★ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন মনের স্মৃতিগুলো ঝাপসা হতে শুরু করেছে। মানুষ চাইলেই কিছু বিষয় এড়াতে পারে না, অস্বীকার করতে পারে না তার প্রভাব। বয়স সে বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।
★ সব প্রশ্নের শতভাগ উত্তর মেলে না। নিয়তির হাতে তোলা থাকে।
★ মানুষ আসলে প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রাণি। তার ক্ষমতা অতি সামান্য। সেই সামান্য ক্ষমতা নিয়ে চোখের পানি ফেলা যায় কেবল, আস্ফালনের কিছু থাকে না।
★ পণ্যের মতো মানুষেরও নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। পার্থক্য হলো পণ্যের গায়ে মেয়াদ সাঁটা থাকে, সবাই দেখতে পারে। মানুষের মেয়াদ লুকানো থাকে।
★ প্রকৃতি কিছু বিষয় অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে অসহনীয়, খুব খারাপ বিষয়ের মধ্যেও দু-একটা ভালো ব্যাপার থাকে।
★ ভালো-মন্দ কোনোকিছুই হুট করে আবির্ভূত হয় না। অনেকদিন ধরে চলে এসে একসময় চরম আকারে পৌঁছায়।
★ মানুষের ভাবনার জগত বড় বিচিত্র, একটা অন্যটার সঙ্গে যুক্ত। সবাই চায় দুর্ভাবনামুক্ত জীবন কাটাতে। অথচ সেটা কোনাভাবেই সম্ভব নয়। মস্তিষ্কের অশান্ত কোষে হুট-হাট করে একেক সময় একেক ভাবনা ঢুকে পড়ে। অনিয়ন্ত্রিত ভাবনারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু অধিকাংশ সময় মানুষ তার ভাবনাকে বাগে রাখতে পারে না।