বই: আজ আমার মন ভালো নেই (aaz-aamar-mon-bhalo-nei pdf)
লেখক: শাদবিন শাকিল
প্রকাশনী: নহলী
মুদ্রিত মূল্য: ২৪০৳
প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২১
কাহিনী সংক্ষেপ:
প্রতিটা পরিবারের ভেতরে কিছু অদেখা গল্প থাকে৷ যেই গল্প ভালো নাকি মন্দ তা কখনো যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আজ আমার মন ভালো নেই উপন্যাসের গল্পটাও অনেকটা সেরকমই।
গল্পের শুরুতে দেখা যায় দুই মামাতো-ফুপাতো বোন নায়লা এবং সোমাকে। মূল গল্পও এদের দুজনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
মেয়ে সোমা, ছেলে সৌরভ এবং ভাতিজি নায়লাকে নিয়ে জাহানারা খাতুনের টানাটানির সংসার। সোমা একটু পাগলাটে ধরণের মেয়ে। খামখেয়ালি স্বভাবের, বই পড়তে এবং লেখালেখি করতে পছন্দ করে৷ অন্যদিকে নায়লা তার ব্যতিক্রম। অন্যের সংসারে বড় হওয়ার গ্লানি থেকেই হয়তো সে সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। তাদের বাসার বাড়িওয়ালি নার্গিস বেগমের ছোটছেলে সাব্বির। নার্গিস বেগমের পরিবারে সাব্বির ছাড়াও রয়েছে তার স্বামী আমজাদ সাহেব, বড় ছেলে সোহেল ও তার স্ত্রী সারা এবং তাদের একমাত্র মেয়ে দীঘি।
সাব্বির হঠাৎ করেই নায়লার পিছনে ঘুরঘুর করতে শুরু করে। অনেক চেষ্টা করেও নায়লা তা এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু সোমাও পছন্দ করে সাব্বিরকে। অন্যদিকে পরকীয়া সম্পর্কের টানে সোহেলের সংসার ছেড়ে অন্যের সাথে চলে যায় সারা। সোমা, নায়লা, সাব্বির ও সোহেলের মাঝে তখন রচিত হয় অদ্ভুত এক গল্পের, যার শেষটা জানতে হলে পড়তে হবে দারুণ এই উপন্যাসটি।
এছাড়াও, উপন্যাসের গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় পার্শ্বচরিত্রসমূহও মূল চরিত্রদের ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রতিটি চরিত্রের রয়েছে আলাদা একটি গল্প। কী সেই গল্প তা উপন্যাসেই পাওয়া যাবে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
একবসায় পড়ে ফেলার মতো দারুণ একটি উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পটিতে বর্তমান সমাজের সাথে মিশে থাকা কিছু গল্পকে রিলেট করায় গল্পের গতিময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। চরিত্র নির্বাচন এবং গল্পের থিম ভালো লাগায়, উপন্যাসটি পড়ে আমি বেশ আনন্দ পেয়েছি।
পাঠ পর্যালোচনা:
শাদবিন শাকিলের লেখার সবচেয়ে বড় যে গুণ তা হচ্ছে তার লেখার সাবলীলতা এবং
দুর্দান্ত স্টোরি টেলিং। কঠিন, খটমটে শব্দ না এনে সহজ ভাষায় সব ধরণের পাঠকের জন্য গল্প লিখে যাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। অনেক লেখকই কঠিন শব্দ ব্যবহারকে একটা পজেটিভ দিক মনে করেন, কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
স্টোরি টেলিং সুন্দর হলে পাঠক খুব সহজেই গল্পটার গভীরে ঢুকে যেতে পারে। থিম যেরকমই হোক না কেন ভালো স্টোরি টেলিং পাঠককে গল্পের শেষ অবধি নিয়ে যেতে সক্ষম। আর এই জায়গাটাতে লেখক শাদবিন শাকিল তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার প্রথম উপন্যাস “যদি তব দেখা পাই” এর মতো এই উপন্যাসেও দারুণ স্টোরি টেলিং করেছেন। যার প্রমাণ পেয়েছি উপন্যাসটি পড়ার সময়ই। সাত ফর্মার এই বইটি এক বসায় দুই ঘণ্টারও কম সময়েই শেষ করেছি। এবং সাবলীলতা থাকায় খুব সহজেই গল্পের ভেতরে ডুবে গিয়ছি।
প্রতিটি চরিত্রকে তিনি বেশ দারুণভাবে ডেভেলপ করেছেন। বিশেষ করে নার্গিস বেগমের চরিত্রের চিত্রায়ণের প্রশংসা করতেই হয়। রহস্যময় এই চরিত্রটিকে কখনো মনে হয়েছে খুব ভালো একজন মানুষ আবার কখনো মনে হয়েছে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ একজন মানুষ। এটাই লেখকের স্বার্থকতা। এছাড়াও সোমা এবং নায়লা চরিত্রের বৈশিষ্টের যে ক্রমপরিবর্তন দেখানো হয়েছে তা গল্পের সাপেক্ষে যথাযথ ছিলো। পরিবেশ পরিস্থিতি ভেদে এই দুই চরিত্রের মানসিক অবস্থার যে পরিবর্তন দেখানো হয়েছে, যেখানে একজন কঠিন পরিবেশে হাল ধরে এবং অন্যজন নিজেকে গুটিয়ে নেয় সকল জটিলতা থেকে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
তবে, সোহেল চরিত্রটিকে আরেকটু হাইলাইট করা যেত। আমার মনে হয়েছে এই চরিত্রটি যেন অনেকটা আড়ালেই রয়ে গেছে। পাঁচ বছর বয়সী দীঘিকে বয়েসের তুলনায় খানিকটা বেশিই পরিপক্ক মনে হয়েছে। তাকে আরেকটু শিশুসুলভ ভূমিকায় রাখলেই বরং ভালো হতো মনে হয়েছে।
গল্পের ডেভেলপমেন্টেও লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সোমা এবং নায়লা চরিত্রের মাধ্যমে দুটি পরিবার এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের দুটি গল্পকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে উপন্যাসটিতে একই সাথে সমাজে বিদ্যমান পজেটিভ এবং নেগেটিভ দুটি বিষয়ই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
চরিত্রের চিত্রায়ণ, স্টোরি টেলিং এবং ডেভেলপমেন্ট এর ব্যাপার বাদ দিলেও একটা উপন্যাসকে সুন্দর করে তোলার জন্য আরো অনেক উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। রূপক, উপমাসহ অন্যান্য লিটারেরি টুলসের ব্যবহার উপন্যাসটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। “আজ আমার মন ভালো নেই” উপন্যাসে লেখক চমৎকার কিছু রূপক এবং উপমার ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও তার বাক্য গঠনের দক্ষতা গল্পটিকে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পুরো উপন্যাস পড়ার সময় বেশ কিছু বাক্যই মন ছুঁয়ে দিয়েছে।
“সব ভালো তার, শেষ ভালো যার” প্রবাদে আমি খুব বেশিই বিশ্বাস করি। বিশেষ করে উপন্যাসের ক্ষেত্রে এন্ডিং আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এই উপন্যাসের এন্ডিংটা চমৎকার হয়েছে। পুরো উপন্যাসের গল্পকে লেখক ঘুড়ির মতো উড়তে দিয়েছেন। তাই উপন্যাসের মাঝপথে গল্পগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তবে শেষাংশে লেখক নিপুণতার সাথে সব লুজ এন্ডগুলোকে এক করেছেন এবং এক সুতোয় গেঁথে একটা পারফেক্ট এন্ডিং উপহার দিয়েছেন।
সবমিলিয়ে বলতে গেলে, “আজ আমার মন ভালো নেই” দারুণ একটি উপন্যাস। এখানে প্রেম-ভালোবাসার গল্প যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ভালোবাসার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতার গল্প। সমাজের দেখা-অদেখা নানা গল্পের ফাঁকে এক টুকরো আলো কিংবা অন্ধকারের গল্প।