ইতিহাস চেতনা, ব্যাখ্যাসহ “বনলতা সেন” কবিতাটির মূলভাব বা সারমর্ম কি টা Pdf Download করে পড়েন নিন। বাংলা কবিতার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র কোনটি এ নিয়ে যদি ভোটিং করা হয়, বনলতা সেন বোধহয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বনলতা সেন নির্বাচিত হবে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কবি জীবনানন্দ দাশের চেয়েও বনলতা সেন বেশি জনপ্রিয়। বনলতা সেন আমাদের স্বপ্ন হয়ে আসে, বনলতা সেন আমাদের গান হয়ে আসে, বনলতা সেন নাটকের চরিত্র হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়।ভাবনায় প্রেমিকের কাছে তার প্রেমিকা বনলতা, প্রেমিকার নিজের কাছে সে নিজে বনলতা।
বনলতা সেন কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যাঃ
কবিতাটির প্রথম স্তবকে, হাজার বছর ব্যাপী ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের কথা বলেছেন কবি : তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে ফিরেছেন;- যার যাত্রাপথ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর অবধি পরিব্যাপ্ত। তার উপস্থিতি ছিল বিম্বিসার অশোকের জগতে যার স্মৃতি আজ ধূসর। এমনকী আরো দূরবর্তী বিদর্ভনগরেও স্বীয় উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন কবি। এই পরিব্যাপ্ত ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অপরিসীম ক্লান্তি। এই ক্লান্তিময় অস্তিত্বের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য শান্তির ঝলক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল বনলতা সেন নামের এক রমণী। কবি জানাচ্ছেন সে নাটোরের বনলতা সেন।
কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে, বনলতা সেনের আশ্চর্য নান্দনিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। বনলতা সেনকে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন অন্ধকারে। তার কেশরাজি সম্পর্কে কবি লিখেছেন : “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”; মুখায়ব প্রতীয়মান হয়েছে শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মতো। বনলতাকে দেখে গভীর সমুদ্রে হাল-ভাঙ্গা জাহাজের দিশেহারা নাবিকের উদ্ধারলাভের অনুভূতি হয়েছে কবির, যেন একটি সবুজ ঘাসের দারূচিনি দ্বীপ সহসা ঐ নাবিকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বনলতা সেনও তার পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়ময় চোখ দুটি তুলে জানতে চেয়েছে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?”
তৃতীয় স্তবকটি ,স্তগতোক্তির মতো মৃদু উচ্চারণে একটি স্বপ্ন-উণ্মোচনের কথা শোনা যায়। কবি জানাচ্ছেন (হেমন্তের) দিন শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যা আসে, ধীরে, ধীরলয়ে শিশিরপাতের টুপটাপ শব্দের মতো। তখন (দিনভর আকাশচারী) চিলের ডানা থেকে রোদের গন্ধ মুছে যায়। এ সময় পাখিদের ঘরে ফিরে আসার তাড়া; এসময় (যেন) সব নদীরও ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর সব আলো মুছে যায়; অন্ধকারে কেবল কয়েকটি জোনাকি জ্বলে। সারাদিনের জাগতিক সব লেনদেন সমাপ্ত হয়েছে; গল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরি; তখন (কেবল) অন্ধকারে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসে গল্প করার অবসর।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরেঅনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতেসেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পরহাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশাসবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘ এতোদিন কোথায় ছিলেন?’পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতনসন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনতখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;সব পাখি ঘরে আসে–সব নদী–ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার মূলভাব বিস্তারিত
- ১/ কেউ কেউ মনে করেন (আমি এই দলের) বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। নামটির দু’টি অংশ বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই একমাত্র শান্তি খুঁজে পেয়েছে কবির মূল বক্তব্য এটিই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি এই নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র।
- ২/ কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে । ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি রাখা আছে। সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্ হিসেবে Y নামে এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তার নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন Y=শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন শোভনার প্রতি কবি দূর্বল ছিলেন। এই শোভনাই হচ্ছেন ওয়াই বা শচী বা বনলতা সেন।
- কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলিতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা।
- ৪/ বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন।
বনলতা সেন কবিতার মূলভাব Pdf-
Download – ব্যাখ্যা পিডিএফ
full-