islamer golpo bd (অনুবাদ গল্প)
দ্বীনের পথে ফিরে আসার গল্প পর্ব ০১ : রুবিন থেকে আবু বকর
মূলত আমার গল্পের শুরু ইউনিভার্সিটি থেকে। একটা বছর, যেই বছরে আমি অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেই বছরেই আমার আব্বু আম্মুর বিচ্ছেদ হয়েছিলো। আমার কুকুরটাও মারা যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি দুই দুইবার সড়ক দূর্ঘটনায় পতিত হই। তাছাড়াও, আমার এক বন্ধু সেই বছরেই মারা যায়।
হয়তোবা এই ঘটনাগুলোই আমাকে বেশ কিছু প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। আমি এখানে কেন? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
তো, আমি তখন থেকে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। সেখান থেকেই আমি একধরণের ‘স্বর্গীয় অনুসন্ধান’ করা শুরু করি। একজন অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে আমি প্রথমেই খ্রিষ্টান ধর্মকে জানার চেষ্টা করি। আমার একটা চার্চ ক্যাম্পে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। সবাই গান গাচ্ছিলো। যদিও শুনতে অনেক ভালই শোনাচ্ছিলো- কিন্তু তাও সেটা ছিলো অদ্ভূত। সেখানে সবাই আমাকে বলছিলো যে ঈশ্বর তোমাকে কত ভালোবাসে! আর আমি চিন্তা করছিলাম, “ঈশ্বর আমাকে ভালোবাসে? আমার পোষা কুকুরটা তো মরে গেলো!’
পর্যায়ক্রমে, খ্রিষ্টান ধর্মের অনেকগুলো দিক আমার সামনে আসতে লাগলো। প্রত্যেকবার যখন আমি তাদের প্রশ্ন করতাম তখন তারা এভাবে বলতো না যে, “ভাই! এই নাও বাইবেল, আর এই যে তোমার প্রশ্নের উত্তর।” বরং তারা নিজস্ব মতামত দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতো। আমি বুঝতে শুরু করলাম, অনেক মানুষের নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা ছিলো। কোনো বিষয়ে এক যাজক একটা ধারণা রাখে ,আবার আরেক যাজকের ছিলো ভিন্ন ব্যাখা। বাইবেল তো একটাই, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বাইবেলের অনেক আলাদা ব্যাখ্যা আছে। এই ব্যাপারটা অনেক গোলমেলে ছিলো।
সেই সময়টাতে আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার পাশাপাশি একটা সার্ভিস স্টেশনে পার্ট টাইম জবও করতাম। সেখানে আমার সাথে একজন ইন্ডিয়ান হিন্দু সহকর্মী ছিলো। সেই সময়টাতে আমি অনেক অনুসন্ধানী ছিলাম। সবাইকে অনেক প্রশ্ন করতাম। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “ভাই, হাতির মতো মাথা ওয়ালা মানুষটার কাহিনী কি? মানে ব্যাপারটা কি?” সে আমাকে বললো, “আরে, এটা তো গণেশ”। আমি তাকে বললাম, “মানে তোমরা তো অন্য কিছুও বাছাই করতে পারতে। যেমন ধরো, একটা সিংহের মাথা? অথবা আরেকটু ভালো কিছু”।
যখন লোকজন এসে আমাদের সার্ভিস স্টেশনে পেট্রোল কিনতো তখন আমরা এই রকম ‘গভীর ধর্মতাত্ত্বিক’ আলাপ জুড়ে দিতাম! কিন্তু, আবারো আমার কাছে মনে হলো এটা (হিন্দু ধর্ম) হজম করা আমার জন্যে কঠিন। তাই আমি আরো কিছু অনুসন্ধান শুরু করলাম।
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি ইহুদিধর্ম সম্পর্কেও পড়েছিলাম। কিন্তু এবারো আমি যা চাচ্ছিলাম আমি সেটা পাইনি।
এবার শেষে এসে বৌদ্ধধর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। আমি ভাবলাম, হয়তো এটাই সেই ধর্ম যেটা আমি বাছাই করতে যাচ্ছি। এটা তো অসাধারণ। মানুষ এখানে শান্তিতে আছে। সবাই শান্তিপ্রিয়। তবে, যতই আমি এটা নিয়ে জানতে পারছিলাম ততই আমার মনে হচ্ছিলো এটা আসলে স্রষ্টার কোনো ধর্ম না, এটা শুধু বেঁচে থাকার একটা ভালো উপায়।
আমার এক খ্রিষ্টান বন্ধু আমাকে বললো, “তুমি কোন কোন ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছো, সেগুলার নাম বলো”। আমি তাকে বলে গেলাম, “খ্রিষ্টানধর্ম, ক্যাথলিক, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম”। সে আমাকে বললো, “ইসলাম নিয়ে পড়ো নাই?” আমি বললাম, “ইসলাম?! ওরা তো জঙ্গি। আমি তাদের ধর্ম সম্পর্কে পড়ব না। তারা পাগল! আমি এই ধর্মের দিকে তাকাবোও না”।
কিন্তু, একদিন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি একটা মসজিদের দিকে যাচ্ছি। আমি জুতা না খুলেই মসজিদে ঢুকে সরাসরি জায়নামাজের উপর দিতে চলে গেলাম। সেখানে একজন নামাজ পড়ছিলো। যখন সে সেজদা করতে যাচ্ছিলো, আমার পা তার মাথার উপরে পড়তেই যাচ্ছিলো। আমার কোনো ধারণাই ছিলো না আমি কি করছি!
আমি খেয়াল করলাম একটা লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভাবলাম, আজকে আমি শেষ! তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে মাত্র সাহারা মরুভূমি থেকে ফেরত আসছে। তার গায়ে ছিলো একটা বড় আবায়া। লম্বা দাঁড়ি।
কিন্তু সুবহান আল্লাহ, সে প্রথমে এসেই আমাকে বললো,“শুভ সকাল ভাই। কি অবস্থা?” সেই সময়টাতে আমি তার এই সুন্দর আচরণে অনেক আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
আমি যখন বড় হই আমার বাবা-মা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যে, “তোমার মৃত্যুর পর তখন তোমাকে পোকামাকড় খেয়ে ফেলবে, এর বেশি কিছু না। পরকাল বলে কিছু নাই। স্রষ্টা-ঈশ্বর এসব কিছু নাই। এগুলা সব ছাইপাঁশ!” আমি একজন নাস্তিক হিসেবেই বড় হয়েছিলাম।
সেই লোকটা আমার সাথে অনেক নম্র-ভদ্র ভাবে কথা বলছিলো, যেটার জন্য এখন আমি আসলেই অনেক কৃতজ্ঞ। কারণ, মুসলিমদের প্রতি আমার আগে থেকেই নেতিবাচক ধারণা ছিলো। তারা আমার সামনে চা বিস্কুট দিতেই থাকে। আমি এতো আতিথেয়তা আগে দেখিনি। অবশ্য আমি শুধু বিস্কুটের জন্যই ওখানে যেতাম এমনটা না, ধর্মটা জানার জন্যও যেতাম।
তো, আমি যখন ঐ ভাইদের সাথে বসলাম আমি তাদেরকে সব ধরণের প্রশ্ন করা শুরু করলাম। যত প্রশ্ন আগে আমি সব পাদ্রী যাজক আর বন্ধুদের করেছি, তার সব। সুবহান আল্লাহ, যেই বিষয়টা আমার মনে দাগ কেটেছিলো সেটা হলো- প্রত্যেকবার আমি যখন তাদের প্রশ্ন করতাম, তারা স্রেফ আমাকে উত্তর দিতো না। তারা কুরআনটা তুলে নিয়ে আমাকে বলতো ‘ ভাই এটা পড়ো’ এবং সেখানেই উত্তর টা থাকতো। প্রত্যেকবার। লম্বা সময় ধরে তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলো। সবই কুরআন দিয়ে।
আমি এটাতে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই বিষয়টাতে তোমার মতামত টা কি? তুমি কেন নিজের মতামত দাও না?” সে আমার দিকে ফিরে বললো, “আমার কোনো মতামত থাকতে পারে না যখন এটা স্রষ্টার নিজের কথা”। সুবহান আল্লাহ! আমার মনে আছে, সেই কথাটা সত্যিই আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছিলো।
আমি তাদের কাছ থেকে একটা কুরআন এনে পড়া শুরু করলাম। কুরআন পড়তে গিয়ে আমার মনে হলো, আমি কোনো গল্প পড়ছি না। আমার মনে হলো কেউ যেন আমাকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। এক রাতে আমি কুরআনের আধ্যাত্মিক অনুভূতি নেয়ার জন্য মনস্থির করলাম। আমি একটা মোমবাতি জ্বালালাম, বাসার জানালা গুলো খোলা রাখলাম। পর্দা টানলাম।
আমি এতোদিন কুরআনের আধ্যাত্মিক প্রমাণ, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সব কিছুর অনুসন্ধান করে আসছিলাম। পাহাড়ের খুঁটি হওয়ার বিষয়টা, নারীর ডিম্বকে মানবভ্রূণের বেড়ে উঠা। এগুলো অসাধারণ প্রমাণ ছিলো। কিন্তু, আমার মনে হচ্ছিলো আমি কোন এক চূড়ার প্রান্তে আছি। লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুত। শুধু একটা ধাক্কার প্রয়োজন ছিলো।
আমি কুরআন পড়ছিলাম। আমি থামলাম। আমি আল্লাহ কে বললাম, “আল্লাহ, এটাই আমার মুহুর্ত। আমি ইসলামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। আমার শুধু একটা নিদর্শন চাই। বড় কিছু না, হতে পারে একটা বিদ্যুতের ঝলকানি। তুমি তো এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছো। তুমি পারবা, পারবা”।
আমি মুভির মতো, মোমবাতির আলো ৪/৫ মিটার উপরে উঠে ঝলক দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি বললাম, “ওকে, এবার হও”। এবং, সুবহান আল্লাহ, কিচ্ছু হয় নাই। আমি হতাশ হয়ে গেলাম। আমি বললাম, “আল্লাহ! এটা তো তোমার সুযোগ ছিলো! আচ্ছা আমি তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি। হয়তো তুমি ব্যস্ত ছিলা। এবার বড়-ছোট যেকোনো নিদর্শন দাও। যেকেনো কিছু”। এবারো, একেবারেই কিচ্ছু হলো না।
আমি ভাবলাম, এটা আমার ইসলামে আসার শেষ সুযোগ ছিল। কিন্তু কিছুই হলো না। তখন আমি কুর’আন টা আবার হাতে নিলাম। যেখানে পড়ছিলাম সেখান থেকে পড়া শুরু করলাম। আমি কুর’আন টা হাতে নেয়ার পর প্রথম যেই আয়াত টা আমার সামনে আসলো সেটা হলো- যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না?… নিশ্চয় আমি প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি। (২:১১৮)”]
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমি আমার নিজের প্রতি দেয়া নিদর্শন গুলোর প্রতি কীভাবে এতোদিন মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। পরের দিন আমি মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরের দিন রাতে আমি মসজিদে গেলাম শাহাদা পাঠ করার জন্য। আমার ভেতর বিভিন্ন ধরনের ভয় কাজ করছিলো। কিন্তু শাহাদার সেই শব্দ গুলা পাঠ করার সাথে সাথেই আমার মনে হতে লাগলো আমার ভেতরে একটা ঝর্ণা বয়ে আমাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।
আমার শাহাদা বাক্য পাঠ করার সাথে সাথে অনেক ভাইয়ের “তাকবীর! আল্লাহু আকবার!” বলা শুরু করে দিলো। তারা আমার সাথে কোলাকুলি করা শুরু করলো, আমাকে চুমুও দেয়া শুরু করলো। আমাকে আমার সারা জীবনে কখনো এতো মানুষ চুমু দেয় নাই!
অবশ্য সেটা একটা সুন্দর দিন ছিলো, আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
(পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত)
—-
[গল্পটা ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে পাওয়া যায়। সেখান থেকে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি।]
অনুবাদকঃ তাহমীদ ইসলাম
দ্বীনের পথে ফিরে আসার গল্প পর্ব ০২ : রুবিন থেকে আবু বকর
কৃতজ্ঞতা: © Tahmid Islam
ক্রেডিট: মিম্বার(Mimbar)