Ekattorer Dinguli pdf – একাত্তরের দিনগুলি বই Pdf Download

Ekattorer Dinguli pdf

Last updated on May 24, 2021

একাত্তরের দিনগুলি বই pdf – Ekattorer Dinguli pdf download

বইয়ের নাম:- একাত্তরের দিনগুলি
রচয়িতা:- জাহানারা ইমাম
জেনার:- দিনলিপি
পৃষ্ঠা সংখ্যা:- ২৬৮
প্রথম প্রকাশ:- ১৯৮৬
প্রকাশন:- সন্ধানী প্রকাশনী
পার্সোনাল রেটিং:- ৫/৫
রিভিউ-
আজ ৩রা মে, ‘শহীদ জননী’ জাহানারা ইমামের ৯২তম জন্মবার্ষিকী।
তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নিছক দিনলিপি নয়। বরং এই গ্রন্থের মধ্যদিয়ে যুদ্ধকালীন বাঙালি জাতির হৃদয়ছবি ফুটে উঠেছে। এই গ্রন্থে তৎকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি এবং গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতা যতটা নিখুঁতভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে ফুটে উঠেছে তা অন্য কোনো বইয়ে ফুটে ওঠেনি বলে অনেক গ্রন্থ সমালোচক মন্তব্য করেছেন। বইটির প্লট ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। যুদ্ধকালে জাহানারা ইমাম এবং তাঁর স্বামী শরীফ ইমামের পারিবারিক ঘটনাবলী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, নৃশংসতা এবং ঢাকা শহরের ভিতরে গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতা ইত্যাদি এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। জাহানারা ইমামের বড় ছেলে ক্রাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য বীর বিক্রম শাফি ইমাম রুমীর গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে দক্ষভাবে গেরিলা অ্যাকশন পরিচালনা এবং পরিশেষে নিজ বাসগৃহ থেকে পাক আর্মিদের কাছে ধরা পড়া ও চিরকালের জন্য নিঁখোজ হয়ে যাওয়া এই বইয়ের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। যুদ্ধ শেষে শহীদ রুমীর জীবিত গেরিলা সহযোদ্ধারা জাহানারা ইমামের সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের জননী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রুমী নিখোঁজ ও শহীদ হওয়ার পর থেকে জাহানারা ইমাম ‘শহীদ জননী’ হিসেবে খ্যাত হন। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে অবশেষে জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
#উল্লেখযোগ্য_চরিত্র:-
 জাহানারা ইমাম, শরীফ ইমাম, শাফি ইমাম রুমী, সাইফ ইমাম জামী(ছোট ছেলে)। এছাড়াও আছেন– জাহানারা ইমামের মা, বাঁকা, ফকির, মঞ্জুর, গেরিলাদের সহায়তাকারী যুবতী মিনি এবং রুমীর গেরিলা প্রশিক্ষক এবং সহযোদ্ধা– (মেজর হায়দার, শাহাদৎ চৌধুরী, হাবিবুল আলম, চুল্লু, আজাদ, বদি, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, স্বপন, জুয়েল, কাজী কামালউদ্দিন, হ্যারিস, উলফত) সহ আরও অনেকে।
#কাহিনী
:- ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ অখণ্ড পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর থেকে দিনদিন ঢাকা শহর উত্তাল হয়ে ওঠে। দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধ, কারফিউ চলতে থাকে। দেশবাসীর দাবি দুই ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। কেউ চায় স্বাধিকার, অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি, আর কেউ চায় স্বাধীন বাংলাদেশ। ৭ই মার্চের ভাষণ, প্রতিরক্ষা দিবস’সহ ২৫শে মার্চের আগ পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরে বইয়ের কাহিনী বিন্যস্ত করেছেন লেখিকা জাহানারা ইমাম। স্বাধিকারের প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক, ২৫শে মার্চ রাতে হঠাৎ করে গোপনে ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়া, এবং সেই থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সূচনার প্রাণবন্ত একটা চিত্র যেন লেখিকা কাহিনী পরম্পরায় বর্ণনা করেছেন। ২৫শে মার্চের ব্ল্যাকআউট, অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্ত্বৃক ঢাকা শহরের ধ্বংসযজ্ঞের ছবি যেন এই গ্রন্থে মূর্তিমান হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে সমগ্র দেশ দখল করে নেয় পাকবাহিনী। কারফিউসহ বিভিন্ন মার্শাল ল’ জারি করে অবরুদ্ধ করে রাখে ঢাকা শহরকে। একের পর এক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কখনো পাকবাহিনীর বিহারিদের সাথে ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে হামলা এবং সম্পত্তি লুট করা, কখনো রাস্তা থেকে যুবকদের চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া, কখনো গুপ্ত ক্লিনিক স্থাপন করে সুস্থ বাঙালিদের ধরে নিয়ে তাদের শরীর থেকে সব রক্ত বের করে নিয়ে হত্যা করে সেই রক্ত জখম পাকবাহিনীর সৈন্যদের জন্য সংগ্রহ করা, কখনো বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, যুবতী, বৃদ্ধা নির্বিশেষে অসংখ্য নারীকে পাকবাহিনীর ধর্ষণ করা, কখনো যাত্রাপথে পরিবহণ বাস থামিয়ে যাত্রীদেরকে নামিয়ে বিহারি কর্ত্বৃক নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড, কখনো গ্রেনেড, রাইফেল, কামান, স্টেনগান, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান প্রভৃতি দিয়ে নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা, ইত্যাদি পাকবাহিনীর সকল বর্বরতা ও নৃশংসতার নিখুঁত অনুষঙ্গ এই বইয়ের পরতে পরতে উপস্থিত রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নিরীহ, অসহায় বাঙালিদের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী পদক্ষেপ।
দেশের তাগড়া যুবকেরা ২৫শে মার্চের পরে লুকিয়ে বর্ডার অতিক্রম করে এবং ভারতের মাটিতে বিভিন্ন ক্যাম্প স্থাপন করে। গঠিত হয় ১১টি সেক্টর।
‘কে ফোর্সের’ অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, যিনি ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। ঢাকা জেলা ছিল ২নং সেক্টরের আওতায়। জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমী ১৪ই জুন গেরিলা হিসেবে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন, যোগ দেন সেক্টর টু’তে খালেদ মোশাররফের অধীনে।
অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন রুমী। বর্তমানের বুয়েটে চান্স পাওয়ার পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ারও সুযোগ পান। অথচ দেশের এমন অবস্থায় স্বার্থপরের মতো আমেরিকায় যেতে তাঁর বিবেকে বাধে। তিনি যুদ্ধে যেতে চান। মরিয়া হয়ে অনেক বুঝানোর পরে অবশেষে তিনি তাঁর মা জাহানারা ইমামকে রাজি করাতে সক্ষম হন তাঁকে যুদ্ধে পাঠানোর জন্য। জাহানারা ইমাম বলেন, “ঠিক আছে। তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।”
রুমী ভারতের আগরতলায় মেলাঘর নামক জায়গায় সেক্টর টু’র অধীনে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। এদিকে ঢাকাসহ সারাদেশে চলতে থাকে পাকবাহিনী এবং বিহারীদের বর্বরতা। একের পর এক বোমা হামলা, হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। তাছাড়া পাকবাহিনী ও বিহারীদেরকে সহায়তা করার জন্য তাদের সাথে যোগ দেয় একদল বাঙালি ঘাতক দালাল, রাজাকার। তারা গঠন করে নগর শান্তি কমিটি।
৮ই আগস্ট রুমী তাঁর গেরিলা সহযোদ্ধা আলম, শাহাদৎ, বদি, স্বপন, কাজী, চুল্লুর সাথে ঢাকায় আসেন গেরিলা অ্যাকশনের মাধ্যমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ নিয়ে। এরপরে ঢাকায় শুরু হয়ে যায় ছোট-বড় অনেক গেরিলা অ্যাকশন। ২৫শে আগস্ট রুমী ও তাঁর কিছু গেরিলা সহযোদ্ধা ঢাকা শহরের বিভিন্ন রোডে সরাসরি অ্যাকশনে গিয়ে অনেক পাকিস্তানি মিলিটারিকে সফলভাবে খতম করেন।
কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার আগেই ২৯শে আগস্ট রাত বারোটার পরে অর্থাৎ ৩০শে আগস্ট প্রথম প্রহরে রুমী তাঁর বাসা থেকেই পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। সেইসাথে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরা পড়েন বদি, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদ, আজাদ, চুল্লুসহ আরও অনেক গেরিলা যোদ্ধা। তাঁদেরকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে কিছু ঘাতক দালাল রাজাকার। শুধু গেরিলাদের নয়, তাঁদের পরিবারের পুরুষদেরকেও ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। রুমীর বাবা শরীফ ইমাম এবং ছোটভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী এবং দুইদিন দুইরাত তাঁদের উপরে অমানুষিক টর্চার করে পাকবাহিনী। তিনদিন পরে শরীফ, জামীসহ গেরিলাদের পরিবারের বাকি সবাইকে ছেড়ে দেয়া হলেও ছাড়া পান না রুমী, আজাদ, চুল্লু, আলতাফ মাহমুদ, বদিসহ অন্য গেরিলা যোদ্ধারা।
রুমীর বাবা শরীফকে তাঁর বন্ধু বাঁকা, ফকির অনুরোধ করেন রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে মার্সি পিটিশন করার জন্য, তাহলে অপূর্ব মেধাবী ছেলে রুমী বেঁচে যাবে। কিন্তু রুমী যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে রুমী চিরকাল অপমানিত হয়ে থাকবেন, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট হয়ে যাবে ভেবে তাঁর দেশপ্রেমিক বাবা শরীফ ইমাম প্রেসিডেন্টের কাছে মার্সি পিটিশন করতে রাজি হননি কিছুতেই। তবে রুমীর সন্ধান পাওয়ার জন্য তিনি বাকিসব পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলেন।
সেকালে ঢাকায় এক পীরের দাপট ছিল। তাকে সবাই ‘পাগলাবাবা’ বলে ডাকতেন। রুমীর মা, বাবা নিয়মিত সেই পাগলাপীরের কাছে যেতেন এবং রুমীর খবর জানার চেষ্টা করতেন। পাগলাপীরের ওখানে অনেক নিখোঁজ মেজর, কর্নেল, এসপির স্ত্রীরাও যেতেন স্বামীর সন্ধানে। যেতেন গেরিলাদের মা, বোনেরাও।
জাহানারা ইমামের মতো আরেকজন মায়ের প্রসঙ্গ রয়েছে এই বইয়ে। তিনি গেরিলা আজাদের মা সাফিয়া বেগম। আজাদ ধরা পড়ার পরেও তিনি আজাদের সাথে গোপনে রমনা থানার কারাগারে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন দিন পাঁচেক। তিনি আজাদকে বলেন, “বাবা কারো নাম বলোনাই তো?” আজাদ বলেন, “না মা, কইনাই। কিন্তু মা, যদি আরও মারে? ভয় লাগে, যদি কইয়া ফেলি?” আজাদের মা তখন বলেন, “বাবা, ওরা যখন মারবো, তুমি শক্ত হইয়া সহ্য কইরো।”
এই আজাদের মা এমন একজন মা, যিনি তাঁর আজাদের জন্য শেষবার যেদিন ভাত ও তরকারি রান্না করে জেলখানায় নিয়ে গিয়ে দেখেন আজাদ নিখোঁজ, সেদিন থেকে তিনি তাঁর বাকি ১৪ বছরের জীবনে আর কখনো ভাত মুখে দেননি। শুধু রুটি খেয়ে বেঁচেছিলেন। ১৪ বছরের বাকি জীবনে তিনি আর কখনো বিছানায় শোননি। শানের শক্ত মেঝেতে শুয়েছেন, কারণ আজাদ পাকবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পরে আর বিছানায় শুতে পারেননি। (যাইহোক, সেটা অন্য বইয়ের কাহিনী।)
রুমীরা ধরা পড়ার পরে কয়েকদিন ঢাকা শহর থমথমে অবস্থায় ছিল। সপ্তাহ খানেক পরেই সেক্টর টু সহ অন্যান্য সেক্টর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন গেরিলারা আসতে থাকেন এবং পাকবাহিনীর ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে থাকেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ শুরু হলে নভেম্বরের শেষদিকে গঠিত হয় বাংলাদেশ–ভারত যৌথবাহিনী। ৩রা ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুদ্ধের শেষ কয়দিন পাকবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেন যৌথবাহিনী। ভারতীয় বিমান বাহিনী পর্যায়ক্রমে পাকবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট ও এয়ারপোর্টে বোমা হামলা করতে করতে পাকবাহিনীকে হয়রান করে দেয়। যুদ্ধের শেষ কয়দিন পাকবাহিনী কারফিউ এবং
ব্ল্যাকআউট অব্যাহত রেখে বাঙালিদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
১৩ই ডিসেম্বর রুমীর বাবা শরীফ ইমাম হার্ট অ্যাটাক করেন। ব্ল্যাকআউটের কারণে হাসপাতালে গিয়েও লোডশেডিংয়ের দরুন লাইফসেভিং মেশিন এবং অক্সিজেনের অভাবে ইন্তেকাল করেন।
অবশেষে যৌথবাহিনীর হামলায় দিশা হারিয়ে ফেলে পাকবাহিনীর প্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ ১৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আবার বিজয়ের আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয় সমগ্র ঢাকার, সমগ্র বাংলাদেশের রাজপথ। কিন্তু রুমী, বদি, আলতাফ মাহমুদ, আজাদেরা কি আর কখনো তাঁদের বাড়িতে ফিরে আসেন?
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া:- গ্রন্থটি জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত দিনলিপি। পুরো একাত্তর সালে তিনি হারিয়েছেন তাঁর বড় ছেলেকে। হারিয়েছেন তাঁর স্বামীকে। তবুও এত শোক সত্ত্বেও বইটিতে আবেগের আতিশয্য নেই, নেই কোনো বুকচেরা আর্তনাদ, নেই মর্মভেদী বিলাপ। তিনি যেন নিরাসক্তভাবেই আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে গেছেন তাঁর বেদনাবিধুর স্মৃতিকথা, যাকে বলা যায় একটি নির্মেদ স্মৃতিকথা।
বইটি পড়ার সময় যেন ১৯৭১ সালের ঢাকা শহরটা চোখের সামনে ভাসে! জাহানারা ইমাম প্রতিদিনকার ঘটনাগুলোর তারিখ উল্লেখ করে করে কাহিনীর বর্ণনা করেছেন বিধায় ঘটনাগুলো যেন আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি যেন অতি নিস্পৃহভাবে বলে গেছেন তাঁর ব্যক্তিজীবনের চরম শোকের কথা! যেন তিনি তাঁর গভীর আবেগকে সংযত করে হৃদয়কে পাষাণে পরিণত করে একজন প্রকৃত শিল্পীর মতোই রচনা করেছেন তাঁর এই ব্যক্তিগত দিনলিপি, যা শেষপর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপি হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে উত্তরসূরী পাঠকদের জন্য ঢাকা শহরের গেরিলাযুদ্ধের একটা অকাট্য দলিল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তবে বইটিতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের যতটা না বর্ণনা আছে, তারচেয়ে বেশি বর্ণিত হয়েছে তাঁর পরিবার, প্রতিবেশীর কথাই। এর মাধ্যমে যুদ্ধকালীন ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের ধ্যান-ধারণা, মেজাজ, ভাবনাচিন্তার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের সমাজবাস্তবতা যেন বইয়ের মধ্যে স্থিরভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
তাছাড়া এই বইয়ে যেন ধর্মব্যবসা বিষয়টির প্রতিও অস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তৎকালীন অসহায় বাঙালিরা তাঁদের নিখোঁজ স্বজনদের খবর জানার জন্য পাগলাপীরের কাছে যেতেন। পাগলাপীরের দরবারে অনেক টাকাপয়সা, মিষ্টি, অমৃতি প্রভৃতি খরচ করা হতো। কিন্তু সেই পাগলাপীর সবাইকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শুধু ভুলিয়েই রেখেছেন। বাস্তবে কোনো উপকারেই আসেননি। নিখোঁজদের কোনো খোঁজও দিতে পারেননি। এর মাধ্যমেই তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির পরিচয় পাওয়া যায়।
তাছাড়া ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মিডিয়া বিশ্বের কাছে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কাছেও পাকবাহিনীর কর্মকাণ্ড কিভাবে ঠান্ডামাথায় গোপন করেছে, মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছে, আসল তথ্য লুকিয়েছে, কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশন, রেডিও, পত্র- পত্রিকাগুলোও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশদ্রোহী, দুষ্কৃতকারী বলে এবং রাজাকারদেরকে দেশপ্রেমী বলে পাকবাহিনীর দালালি করেছে, সেটাও এই বইয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জাহানারা ইমাম ফুটিয়ে তুলেছেন, যা বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি জাহানারা ইমাম এবং শরীফ ইমাম কিভাবে গোপনে মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের জন্য ওষুধ, চাল, ডাল, সুজি, চিনি, পোষাক, শীতের সুয়েটার ইত্যাদি কিনে গেস্টরুমে লুকিয়ে রেখে এবং গেরিলাদের টাকা-পয়সা দিয়ে আর্থিকভাবে সহায়তা করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশপ্রেমে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তারও একটা চিত্র যেন এই বইয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কাজেই বর্তমান প্রজন্মের প্রতিটি পাঠকের উচিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটিকে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *