Book | জোছনা ও জননীর গল্প |
Author | হুমায়ূন আহমেদ |
Publisher | অন্যপ্রকাশ |
ISBN | 9848682767 |
Edition | 8th |
Number of Pages | 528 |
Country | বাংলাদেশ |
Format | epub, MOBI, Pdf free Download(পিডিএফ ডাউনলোড) |
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর সম্পূর্ণ জীবদ্দশাতে যদি এই একটামাত্র উপন্যাসও লিখতেন, আমার ধারণা তাতেও তিনি কালজয়ী হয়েই অস্তপারে নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতেন। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এমনই চমৎকার, অসাধারণ আর গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস।
কিছু কিছু বইয়ের রিভিউ লেখা কষ্টসাধ্য। একটু মনে হয় অসম্ভবও। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইটাকে সেরকম একটা বইয়ের কাতারে ফেলা যায়। তবুও এই বইয়ের রিভিউ লেখার দুঃসাহস দেখাচ্ছি। ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন।
বইয়ের রিভিউ লিখতে হলে চরিত্র আলোকপাত করতে হয়। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইটির চরিত্র বলতে হলে সেখানে আসবে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দিন আহমেদ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী , জিয়াউর রহমান আর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সব সদস্য। পাকিস্তানী বাহিনীর সব চরিত্রও এই বইতে স্থান পেয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছে ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, রাও ফরমান আলী, মেজর জামশেদ থেকে শুরু করে আরো সব সেক্টর কমান্ডারেরা। বইটিকে প্রাণবন্ত করতে লেখক তাঁর
শোনা আর দেখা মুক্তিযুদ্ধের আরো কিছু চরিত্রকে এখানে টেনে এনেছেন যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এতে এটা ভাবার অবকাশ নেই যে সেই চরিত্রকে ঘিরে ঘটা ঘটনাগুলো বুঝি সত্যি নয় , উপন্যাসের প্রতিটি ঘটনাই সত্যি।
উপন্যাসের শুরুটা হয় ১৯৭১ সালের এক রাত থেকে। ঢাকায় তখন সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ঢাকায় তখন মিছিল শুরু হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। এমনই এক মিছিলের মাঝে আটকা পড়া ইরতাজউদ্দিনকে দিয়েই শুরু হয়েছে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের প্লট।
‘জয় বাংলা’ মিছিল থেকে শুরু হওয়া উপন্যাস আস্তে আস্তে ২৫ শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ, দেশের ভেতরে গড়ে ওঠা গেরিলা আক্রমণ, ভারতের শরণার্থী শিবির, বুদ্ধিজীবি হত্যা থেকে শুরু করে বিজয় আনয়ন – প্রতিটি ঘটনাতেই পাঠককে ঘুরিয়ে আনবে।
বইটিতে আরো চমৎকার যে ব্যাবস্থা লেখক করেছেন সেটি হল, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উৎস হিসেবে সেটি লেখক কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন সেটার রেফারেন্স পৃষ্ঠার নিচে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই চমৎকার কাজটি বই পড়াকে আরো সুখপাঠ্য করেছে।
‘জোছনা ও জননী গল্প’ এর লেখক ও তাঁর পরিবার নিজেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। লেখকের বাবা স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো একজন শহীদ। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নিজস্ব অভিজ্ঞতাও তাই লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। তবে সেটা উপন্যাসের স্বার্থেই। খুব বেশি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি এটাকে আত্মজীবনী বানানোর চেষ্টা করেননি। খুব সম্ভবত লেখার সময়ই লেখক এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন।
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইয়ের শুরুতে লেখক ‘পূর্বকথা’ অংশে নিজের কিছু কথা লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন,
“সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব আর সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ংকর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি”
ভয়ংকর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক? তা বটে! সত্যিই পড়তে পড়তে সেরকমটাই লেগেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা পড়তে গিয়ে যেমন চমকে উঠেছি, আলবদর শান্তি কমিটির দেশমাতার সাথে বেঈমানী দেখে যেমন ঘৃণা জেগেছে, তেমনি মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহসিকতা দেখে পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ দেখেও হাহাকার জেগেছে, অবচেতনভাবেই বলে উঠেছি – “আহারে!”
‘জয় বাংলা’র মিছিল দিয়ে শুরু গল্প শেষ হয়েছে বিজয় দিবসে গিয়ে। পুরো উপন্যাসই আমি পড়ে গেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত, পাতার পর পাতা উলটে গেছি চালিত যন্ত্রের মত।এত মোটা আর দীর্ঘ কলেবরের বই কিন্তু এতটুকু বিরক্তি আসেনি কখনও।কিছু কিছু বই পড়ে মনে হয় “ইশ! এই বইটি কেন শেষ হল?” এই বইটি আমার তেমনই মনে হয়েছে। আহারে! আরেকটু যদি পড়তে পারতাম।
পূর্বকথনের যে প্যারাটুকু আমি উপরে উদ্ধৃত করেছি তার শেষ লাইনে লেখক লিখেছেন, “তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য”। লেখকের মানবজীবন ধন্য হয়েছে কিনা বলতে পারব না, তবে লেখকের এই অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি পড়ে আমার মানবজীবন আরেকটু ধন্য হল!